আজ কলমের জাদুকর খ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের অনন্তলোকে পাড়ি দেওয়ার বেদনাবিধুর দিন। ২০১২ সালের এই দিনে অজস্র পাঠক আর দর্শককে কাঁদিয়ে পরপারে যাত্রা করেন তিনি। শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদকে দর্শক প্রথম চিনেছিলেন নাট্যকার হিসেবে। আশির দশকে বিটিভিতে তাঁর রচিত ‘এই সব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সেই সঙ্গে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে হুমায়ূন আহমেদের নাম। এরপর আরও অনেক দর্শকপ্রিয় নাটক নির্মাণ ও পরিচালনা করেছেন তিনি। একসময় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও শোবিজ জগতে যাত্রা শুরু করেন তিনি। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসাটা তাঁর জন্য খুব সহজ ছিল না। হুমায়ূন আহমেদকে সিনেমা তৈরির স্বপ্ন দেখান ফিজিকসের ছাত্র আনিস সাবেত।
তার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে। ফিজিকস নিয়ে পড়লেও আনিস প্রায়ই শোনাতেন আলো-আঁধারের গল্প, স্বপ্ন দেখতেন ছবি বানানোর। এমনকি সে সময়ে আহমদ ছফার ‘ওংকার’ উপন্যাস নিয়ে চিত্রনাট্যও লিখে ফেলেন তিনি। কিন্তু সেটা পর্দায় আনার আগেই পড়াশোনার তাগিদে দেশ ছাড়তে হয়। তবে স্বপ্ন ছাড়েননি, বিদেশের মাটিতে বসেই বানালেন নিজের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, জিতলেন পুরস্কারও। ১০ বছর পর দেশে ফিরে সে গল্প শুনিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদকে। তারপর হঠাৎ হানা দিল ক্যানসার, আনিস সাবেতকে স্বপ্নের সঙ্গে বিসর্জন দিতে হয়েছিল জীবনকেও। তার চলে যাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদের মনে সেই স্বপ্ন ঢুকে গেছে। এক দিন ভোরবেলা স্ত্রী গুলতেকিনকে জানালেন সেই স্বপ্নের কথা, ছবি বানানোর কথা। ছবির নাম ‘আগুনের পরশমণি’। চাইলেই কি আর ছবি বানানো যায়। আবার স্বপ্নকেও তো নিজ হাতে মারা যায় না। নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’কে চিত্রনাট্যে রূপ দিতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে সিনেমা তৈরির ওপর লেখা দেশি-বিদেশি বই খুঁজে সেগুলো পড়তে শুরু করলেন। বইয়ের জন্য সাহায্য নিলেন বন্ধুদের। এদিকে আরেক সমস্যা এসে জুড়ে বসল। হয় অধ্যাপক হওয়ার জন্য রিসার্চের কাজ চালিয়ে যেতে হবে, নয়তো সিনেমা
নিয়ে থাকতে হবে। মনের কথা শুনে রিসার্চ বাদ দিয়ে চিত্রনাট্যে মনোনিবেশ করলেন। তবে তাঁর ভাগ্য সহায় ছিল। দুটোই পেলেন একসঙ্গে। হাতে চিত্রনাট্য, মনে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন; কিন্তু পকেট ফাঁকা। ফাঁকা বলতে শূন্য না, হাতে মাত্র ২ লাখ টাকা। সিনেমার জন্য এটা ফাঁকাই ধরা যায়। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন বন্ধু এবং নাট্যাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। দিনভর দুজনে মিলে অর্থ সন্ধানে ঘোরাঘুরি করলেও মানুষের কাছ থেকে শুধু উৎসাহই মেলাতে পারলেন। রাতে একাকী ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো তথ্যমন্ত্রীর নাম, সেখানে গিয়েও হতাশা নিয়েই ফিরতে হলো। শেষে ঠিক করলেন বাসা বিক্রি করবেন, তবু ছবি বানাবেনই। এরই মধ্যে সুখবর মিলল সরকার আবার ছবির জন্য অনুদান প্রথা চালু করেছে এবং সেখানে তিনটা ছবির মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমণির নাম। আবার আরেক বিপদ এসে হাজির, সিনেমার জন্য বসতে হবে পরীক্ষায়। পরিচালক সমিতি গোঁ ধরেছে তারা পরীক্ষা নেবে। যদি সেখানে উত্তীর্ণ হতে পারেন, তবেই সিনেমা বানাতে পারবেন। ছবির জগতে পরিচিত মুখ চাষী নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে জনাবিশেক মানুষের সামনে বসতে হলো পরীক্ষায়। কোনোমতে পাস নম্বর পেয়ে মিলেছিল সহযোগী সদস্যপদ। সিনেমার জগতে পরিচিত চারটি শব্দ লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট। কিন্তু পরিচালক প্রথম দিনেই ভুলে গেলেন কাট বলার কথা। ক্যামেরা চলছে, ক্যামেরাম্যান আখতার সাহেব সেটা মনে করিয়ে দিলেন। কিন্তু যতক্ষণে কাট বলেছেন, ততক্ষণে পরের দিন খবরের পাতায় এ খবর উঠে এসেছে। এ নিয়ে হয়েছে প্রচুর হাস্যরস। এসব অবশ্য তিনি গায়ে মাখলেন না। সিনেমা বানানো শেষ, এসে ঠেকল সেন্সরে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়, চিত্রনাট্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ থাকায় সেন্সরে সেটা নিয়েই ঝামেলা বাধল। যদিও মিসির আলির মতো যুক্তি দিয়ে সেটা উতরে যান তিনি। ১৯৯৪ সালে ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পেল এবং মানুষের মন জয় করে নিল। শুধু তাই নয়, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবিসহ একাধিক সম্মান। পূরণ হলো আনিস সাবেতের স্বপ্ন, সেই সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদও চলচ্চিত্র নির্মাণে মুনশিয়ানা দেখিয়ে এই জগতেই থিতু হলেন।