এক সময়ে ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর। যেখানে বালির নিচেই লুকিয়ে ছিল অমূল্য রত্ন। হাত দিয়ে বালি সরালেই মিলত হীরা! সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া সেই স্বর্ণযুগের শহর আজ শুধুই অতীতের ছায়া—নাম তার কোলম্যানস্কোপ।
আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে নামিবিয়ার নামিব মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভূতুড়ে শহরের অবস্থান বন্দরনগরী লিউডেরিৎজ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। এক সময় ছিল এই শহরে স্কুল, হাসপাতাল, থিয়েটার, বলরুম, ক্যাসিনো, এমনকি দক্ষিণ গোলার্ধের প্রথম এক্স-রে কেন্দ্রও। আফ্রিকার প্রথম ট্রামও চলেছিল এখানেই।
জার্মান উপনিবেশিক আমলে ১৯০৮ সালে এই অঞ্চলে রেললাইন পাতার কাজ চলছিল। হঠাৎই এক কর্মী খুঁজে পান একটি উজ্জ্বল পাথর। পরে জানা যায়, সেটি হীরা। এরপর থেকেই শুরু হয় হিরে উত্তোলনের উন্মাদনা। জার্মান সরকার দ্রুত এলাকাটিকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করে। একসময় বিশ্বের মোট হিরে উত্তোলনের ১২ শতাংশ আসত এই কোলম্যানস্কোপ থেকেই।
এই মরুশহরের নামকরণ নিয়েও আছে একটি গল্প। শোনা যায়, জনি কোলম্যান নামে এক গাড়োয়ান একবার বালির ঝড়ে পড়লে নিজের গাড়ি ফেলে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে সেই নামেই জায়গাটির নাম হয়ে যায় ‘কোলম্যানস্কোপ’—মানে ‘কোলম্যানের পাহাড়’।
শহরটি দ্রুত উন্নত হয়। বিলাসবহুল জীবনযাত্রা গড়ে ওঠে মরুভূমির বুকে। হীরার টাকায় গড়ে ওঠে ইউরোপীয় কায়দায় নির্মিত রাজকীয় বাড়িঘর। মরুপ্রদেশ হলেও সেসময় পানীয় জল থেকে শুরু করে জার্মান শ্যাম্পেন—কিছুই ছিল না যা এখানে মজুত ছিল না।
কিন্তু সুদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে হীরার খনি শুকিয়ে আসতে থাকে। ১৯৩০-এর দশকে শহর থেকে বহু দূরে আরও এক হীরার খনি আবিষ্কৃত হলে ব্যবসায়ীরা স্থানান্তরিত হয়ে যান। ক্রমে শহরটির গুরুত্ব কমে যায়। ১৯৫৪ সালের মধ্যে শহরটি একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৯৫৬ সালে শহরের শেষ কয়েকটি পরিবারও তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে যায়।
আজ এই শহর শুধুই এক ভূতুড়ে স্মৃতি। মরুভূমির বালি দখল করে নিয়েছে প্রতিটি ঘর। জার্মান কায়দায় নির্মিত দালানগুলো আজ বালির চাপা পড়ে একরকম ইতিহাসের পাতায় বিলীন হয়ে যেতে বসেছে। দেওয়ালের উজ্জ্বল রং ম্লান, দরজাগুলোর কব্জা ভেঙে পড়েছে, বাড়িগুলোর মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে মরুভূমির সাপ ও সরীসৃপ।
তবে এই ভূতুড়ে শহরের ইতিহাস এখন পর্যটকদের কাছে এক বড় আকর্ষণ। স্থানীয় প্রশাসনের বিশেষ অনুমতি নিয়ে প্রতি দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১১টা এবং রবিবার সকাল ১০টা থেকে পর্যটকেরা ঘুরে দেখতে পারেন কোলম্যানস্কোপ। হাঁটু-জল বালির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্নদশা ভবনগুলির ফাঁকে আজও উঁকি দেয় ইতিহাস। বালির নিচে লুকিয়ে থাকে সেই আফ্রিকার প্রথম ট্রামলাইন।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল