আজ থেকে আট-দশ বছর আগেও ঈদ আসলে দোকানগুলো সাজানো থাকত বাহারি রঙের ঈদ কার্ডে। পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো এসব ঈদ কার্ড। নানা বয়সী মানুষের মধ্যে ছিল ব্যাপক চাহিদা। তবে এখন মানুষ আর ঈদ কার্ড কেনে না। মোবাইলেই কৃত্রিমভাবে শুভেচ্ছা ও অনুভূতির আদান-প্রদান করেন। শনিবার দুপুরে এসব কথা বলছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী শহরের গণমোড় এলাকার ‘পদ্মা কসমেটিকস’-এর প্রোপ্রাইটর সুকুমার সাহা।
তার ভাষ্য, প্রায় ৩৫ বছর ধরে কসমেটিকসের ব্যবসা করছেন। বর্তমানে তার দোকানে স্নো, পাউডার, সাবান, কাঁচের চুড়িসহ অন্তত দুই হাজার ধরনের পণ্যের পসরা সাজানো রয়েছে। তবে সেখানে নেই শুধু এক সময়ের ঈদ কার্ড।
বন্ধু, তুমি অনেক দূরে, তাই তো তোমায় মনে পড়ে...
বাঁকা চাঁদের হাসিতে, দাওয়াত দিলাম আসিতে...
ঈদকে ঘিরে প্রায় এক যুগ আগেও এসব বাণী লেখা ঈদ কার্ডের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধবসহ নানা শ্রেণির মানুষ। কে কাকে আগে ঈদের কার্ড দেবেন—এ নিয়েও চলত প্রতিযোগিতা। প্রিয়জনের কার্ড ছাড়া যেন ঈদের আনন্দ অপূর্ণ থাকত। তবে কালের বিবর্তনে আর মোবাইল ফোনের প্রযুক্তির কাছে হেরে গেছে এই আবেগের মাধ্যম। এখন হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে চলছে ডিজিটাল শুভেচ্ছার লেনদেন।
কুমারখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. মামুনুর রশীদ সিদ্দিক বলেন, "ছোটবেলায় ঈদ আসার আগেই কার্ড কেনার জন্য ব্যস্ত থাকতাম। খুব কাছের বন্ধুদের কার্ড দিতাম। এমনকি শত্রুদেরও কার্ড পাঠাতাম। কার্ড না দিলে বন্ধুরা অভিমান করত। কার্ড ছাড়া ঈদই যেন হতো না!"
কুমারখালী শহরের হলবাজার, গণমোড়, থানামোড়, পাবলিক লাইব্রেরি এলাকার ধ্রুবতারা, পদ্মা, কৃষ্ণ গোপাল, অনন্যা, মীমসহ অন্তত ২০টি কসমেটিকস দোকান ঘুরে দেখা গেছে। হাজারো পণ্যের পসরা থাকলেও সেখানে নেই ঈদ কার্ড।
এ সময় ‘ধ্রুবতারা কসমেটিকস’-এর প্রোপ্রাইটর স্বপন হোসেন বলেন, "অনেক বছর হলো ক্রেতারা ঈদ কার্ড চায় না। বিক্রিও হয় না। সেজন্য এগুলো আর দোকানে তোলা হয় না।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, "১০-১৫ বছর আগেও ঈদ কার্ডের প্রচলন ছিল। ছোটবেলায় অনেক কার্ড পেয়েছি। এখন আর কেউ দেয় না।"
কুমারখালী আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন, "ঈদ কার্ড কী? কখনো দেখিনি। চিঠিও লেখা হয়নি কোনোদিন!"
৯০-এর দশকে ঈদ কার্ডের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কার্ড কেনার জন্য সারাবছর ধরে এক-দুই টাকা করে জমানো হতো, জানান স্থানীয় কবি ও নাট্যকার লিটন আব্বাস। তিনি বলেন, "ঈদ কার্ড সংগ্রহ করে তাতে নিজস্ব অথবা কোনো বিখ্যাত কবির কয়েকটি লাইন লিখে প্রিয়জনকে দাওয়াত দেওয়া হতো। কিন্তু এখন মোবাইল ফোনের কারণে ঈদ কার্ড বিলুপ্তির পথে। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঈদ কার্ড আবার চালু হওয়া উচিত।"
জানা গেছে, অনলাইনে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এবার বেশ কিছু ঈদ কার্ড কিনে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নূর ই সিয়াম উচ্চারণ। তিনি বলেন, "২০১৩ সালে চাচাতো বোন প্রথম ঈদ কার্ড দিয়েছিল। তারপর আর দেওয়া-নেওয়া হয়নি। তবে এবার বেশ কিছু কিনেছি প্রিয়জনদের জন্য। আমাদের প্রাচীন এই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।"
কাগজে-কলমে লিখে মনের ভাব যে গভীরভাবে প্রকাশ করা যায়, তা যান্ত্রিক মাধ্যমে সম্ভব নয়, মন্তব্য করেছেন কুমারখালী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জিল্লুর রহমান মধু। তিনি বলেন, "একটা সময় হালখাতা কার্ডের প্রচলন ছিল। তেমনি ঈদেও ঈদ কার্ড ছিল। এখন কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে যাচ্ছে। তবে নতুন প্রজন্মের মাঝে পুরনো এসব সংস্কৃতি আবার ফিরিয়ে আনা উচিত।"
বিডি প্রতিদিন/আশিক