ঘনবসতিপূর্ণ ও জনবহুল এলাকায় বিমান চালনা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উড্ডয়ন ও নিরাপত্তা খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এ ধরনের এলাকায় প্রশিক্ষণ চালানো শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, বরং একটি দুর্ঘটনা ঘটলে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। শিক্ষানবিশ পাইলটদের দিয়ে যে কোনো জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ উড্ডয়ন করানো হলে তা জননিরাপত্তার জন্য স্পষ্ট হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত নিয়ম অনুযায়ী কম জনসংখ্যা ও খোলা জায়গায় এ ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো উচিত। এ ছাড়া রাজধানীর উপকণ্ঠে একটি যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা ও জনবহুল এলাকার ওপর দিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন করায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশিক্ষণ বিমানের নিরাপদ এলাকা নির্ধারণে সরকারের ত্রুটি নিয়ে চলছে নানান সমালোচনা।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক রাজধানীসহ দেশের যে কোনো জনবহুল এলাকার আকাশে বিমান প্রশিক্ষণ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। বিবৃতিতে তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যে কোনো জনবহুল এলাকার আকাশে বিমান প্রশিক্ষণ বন্ধ করার দাবি জানায়।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে আরও বিবেচনা করা জরুরি। ভবিষ্যতে বিমান প্রশিক্ষণ কোথায় হবে, তা নতুন করে ভাবতে হবে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর এ প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।’ তিনি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আহতদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরও যাচাইবাছাই করতে হবে। বিমান নানান কারণে বিধ্বস্ত হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান কারণ পাইলট এরর এবং টেকনিক্যাল সমস্যা। যদিও বিমানগুলো পুরোনো। এগুলো ট্রেনিং জেট। ব্ল্যাকবক্স অ্যানালাইসিস না করা পর্যন্ত বোঝা যাবে না এটা টেকনিক্যাল এরর, নাকি পাইলটের ভুল। পাইলট ভুলের কারণেও বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। বিমান যিনি ওড়াচ্ছিলেন তিনি মারা গেছেন, এটা খুবই মর্মান্তিক।’
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য, এভিয়েশনবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদক কাজী ওয়াহেদুল আলম বলন, ‘১৯৬৪ সালে যখন এ বিমানবন্দর তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় ও পরিকল্পনা করা হয়, তখন পাকিস্তানের প্রাদেশিক একটি রাজধানীর বিমানবন্দর হিসেবে এটি বিবেচিত হয়। তখন গুটিকয় এয়ারক্রাফট এখানে ওঠানামা করত। আর তখনকার দিনে উত্তরা, টঙ্গী, আশুলিয়ার দিকে কোনো বসতিই ছিল না। এ বিমানবন্দর যখন ১৯৮১ সালে উদ্বোধন হলো, তখনো ওই এলাকাগুলোয় সেভাবে বসতি ছিল না। তার পরে যেভাবে জনবসতি বেড়েছে ওইসব এলাকায়, এটা তো এখন উদ্বেগজনক অবস্থা। এখন ওই এলাকায় হাজারো গার্মেন্ট কারখানা, শিল্প। লাখ লাখ মানুষের বসবাস। যদি কোনোভাবে একটি বড় যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয় তাহলে কত মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে? এমন জনবহুল এলকায় কোনো বিমানবন্দর থাকা উচিত না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমন একটি স্পর্শকাতর এলাকায় স্কুল বানানো হলো। তারা কি সিভিল এভিয়েশন থেকে অনুমোদন নিয়েছিল? যদি নিয়ে থাকে কারা অনুমোদন দিয়েছিল? বাংলাদেশে কেউ আইন মানতে চায় না। জোর করে সবকিছু করতে চায়। এখানে সম্ভবত তেমন হয়েছে। এটা আমাদের জন্য ভয়ানক একটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে আছে। এখানে একটা প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ায় কতগুলো শিশুর প্রাণহানি হলো। আর যদি তিন-চার শ যাত্রী নিয়ে কোনো উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হতো, তাহলে কী অবস্থা হতো সেটা ভাবতে চাই না।’
বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘একটা প্রশিক্ষণ বিমান তা-ও ফাইটার বিমানের প্রশিক্ষণ এমন একটা জনবসতিপূর্ণ শহরে হয় কি না? আমরা জানি এ ধরনের প্রশিক্ষণ হয় যেখানে জনগণ থাকে না, এ রকম অনেক জায়গায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ ঢাকা শহরের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হলো কেন? এ প্রশ্নগুলো আজ জনগণের মনে উঠেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। যাতে ভবিষ্যতে এমন আরেকটা দুর্ঘটনার জন্ম না দেয়, তার জন্য সতর্ক থাকতে জাতির এটা জানা উচিত।’
ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানের প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক দিন ধরেই সংক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রতিদিন ছোট ছোট বিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়।
মানুষ সব সময় ভয়ে থাকে কখন কী হয়! মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হতাহত শিক্ষার্থীদের স্বজন ও সহপাঠীরা বলেছে, পৃথিবীর কোথাও এত ঘনবতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং বিমানবন্দর নেই।