দেশের ৪ কোটি শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতি বছর দুবার করে বিনামূল্যে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াত সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে কৃমি নির্মূলের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। কিন্তু বরাদ্দ না থাকায় ওষুধসংকটে এক বছর ধরে শিশুদের কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে না। শুধু এই কর্মসূচি নয়, জলাতঙ্ক প্রতিরোধে অ্যান্টি র্যাবিশ টিকাও বন্ধ রয়েছে ওষুধের সংকটে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ৩৮টি স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি (এইচএনপিএসপি) অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি’র মাধ্যমে রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করত সরকার। কিন্তু হঠাৎ করে ওপি বন্ধ করে দেওয়ায় বরাদ্দের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা। ওপি বন্ধ করে দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করেছে সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়নি। অথচ এর মধ্যেই দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পের এক বছর শেষ হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার অধীনে পরিচালিত হতো সাতটি কর্মসূচি। এর মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, ফাইলেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, কালাজ্বর নির্মূল, জুনেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণ (জলাতঙ্ক, নিপাহ), অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন কর্মসূচি (আইএইচআর)। এ ছাড়া সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডিজিজ সারভ্যাইলেন্স কর্মসূচি বাস্তবায়ন করত। এসব রোগনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য চতুর্থ কর্মবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রতি বছর শুধু সিডিসিকেই ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হতো। কিন্তু হঠাৎ করে সব বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে রোগনিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরাদ্দের অভাবে এ বছর শিশুদের জন্য কৃমিনাশক ৮ কোটি টাকার ওষুধ কেনা হয়নি। সর্বশেষ গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে সারা দেশের শিশুদের কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এক বছর পার হলেও এ কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। অর্থস্বল্পতার জন্য জলাতঙ্ক প্রতিরোধে অ্যান্টি র্যাবিশ ভ্যাকসিন কেনা হচ্ছে না। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলে অল্প কিছু ভ্যাকসিন কেনা হলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ম্যাস ডগ ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচিও থমকে গেছে। সরকারিভাবে বিনামূল্যে ওষুধ-টিকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ছে জলাতঙ্কের ঝুঁকি।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংকট কাটিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে নিতে আমরা চেষ্টা করছি। এর মধ্যে র্যাবিশ ভ্যাকসিন কিনে সরবরাহ করা হয়েছে।’ প্রকল্প অনুমোদনে দেরি হলে পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার হাতে নেই। এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাইছি না।’
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর তিনটি জরিপ পরিচালনা করা হয় ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব জরিপ করে ডেঙ্গু পরিস্থিতির পূর্বাভাস জানায় সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। এ থেকে রাজধানীর নির্দিষ্ট এলাকার মানুষও ডেঙ্গুর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পেরে সচেতন হতে পারে। কিন্তু ওপি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ বছর জরিপ পরিচালনা করতে পারেনি ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। আইইডিসিআর ফেব্রুয়ারি মাসে জরিপ পরিচালনা করলেও তার ফল প্রকাশ করেছে জুনে। ফলে আদতে কোনো কাজেই আসেনি এ জরিপ প্রতিবেদন।
সংকটের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘দেশের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মসূচিতে ওপি’র অনেক সাফল্য রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ ওপি মানেই দুর্নীতি মনে করে। দুর্নীতি তো দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গাতেই হয়েছে, তাই বলে তো সব বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। দুর্নীতির কারণগুলো শনাক্ত করে সমাধান করতে হবে। ওপি বন্ধ করে দেওয়া একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। এটা বন্ধ করে দুই বছর মেয়াদি যে প্রকল্প নিতে চাইছে এর মধ্যেই তার এক বছর পার হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলছিল। চতুর্থ কর্মবার্ষিক পরিকল্পনায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে মানুষ ও কুকুরের টিকার পেছনেই ব্যয় করা হয়েছে ৩৩০ কোটি টাকা। এখন এসব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে সব বিনিয়োগ বিফলে যাবে। এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কঠিন হয়ে পড়বে।’