মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার আলাস্কার দূরবর্তী শহর অ্যাঙ্কোরেজে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এই বৈঠককে দুই দেশের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখানে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
ট্রাম্পের সফরসঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট, বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিক এবং সিআইএ (মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা) পরিচালক জন র্যাটক্লিফসহ অন্যান্য কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ শুরুর পর এটাই পুতিনের প্রথম পশ্চিমা সফর।
অনুষ্ঠেয় এই শীর্ষ সম্মেলন বিগত বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু এই বৈঠক যদি একই স্থানে দেড়শ বছর আগে অনুষ্ঠিত হতো তবে তা রাশিয়ার ভূখণ্ডে হতো। এর কারণ, আলাস্কা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অঙ্গরাজ্য, যা পুরো দেশের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ জমি জুড়ে বিস্তৃত হলেও একসময় তা রাশিয়ার মালিকানাধীন ছিল।
উত্তর আমেরিকার কিছুটা দূরে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আলাস্কাকে বেরিং প্রণালী রাশিয়ার থেকে পৃথক করেছে, যেটির সবচেয়ে সরু অংশ ৫০ মাইলের কিছুটা বেশি চওড়া। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন আলাস্কায় এই বৈঠক করার ঘোষণা দেন তখন রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকোভ বলেন, রাশিয়ান প্রতিনিধি দলের জন্য ‘শুধু বেরিং প্রণালী দিয়ে উড়ে আসা এবং দুই দেশের নেতাদের জন্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতীক্ষিত সম্মেলন আলাস্কায় আয়োজন করা একেবারেই যৌক্তিক’ বলে মনে হয়েছে।
রাশিয়া ও আলাস্কার মধ্যকার এই ঐতিহাসিক সম্পর্কের সূত্রপাত ১৭০০ সালের গোড়ার দিকে। যখন সাইবেরিয়ার আদিবাসীরা প্রথমবারের মতো পূর্ব দিকে অবস্থিত বিশাল এক ভূখণ্ডের কথা বলেছিলো। জানার জন্য ড্যানিশ নাবিক ভাইটাস বেরিং এর নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়। নতুন ভূখণ্ডটি রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত নয় এমন তথ্য আবিষ্কার হয় সেখানে। তবে ঘন কুয়াশার কারণে অভিযানটি ব্যর্থ হয়।
ভাইটাস বেরিংয়ের নেতৃত্বে ১৭৪১ সালে পরিচালিত আরেকটি অভিযান সফল হওয়ায় আলাস্কা উপকূলে মানুষ পাঠানো হয়। এরপরে একাধিক অভিযান পরিচালিত হয় এবং এসব অভিযানের পর যখন সামুদ্রিক ভোঁদড়ের পশম বা লোম রাশিয়ায় আনা হয় তখন ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের মধ্যে একটি লাভজনক বাণিজ্যের পথ খুলে যায়।
তবে ঊনবিংশ শতকের দিকে ব্রিটিশ এবং আমেরিকান পশম ব্যবসায়ীরা রাশিয়ানদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১৮২৪ সালে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিরসন হয় যখন রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
সামুদ্রিক ভোঁদড়ের প্রায় বিলুপ্তি এবং ক্রিমিয়ান যুদ্ধের (১৮৫৩ - ৫৬) রাজনৈতিক প্রভাবে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রি করতে রাজি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ড জমি কেনার আলোচনা চালান এবং রাশিয়ানদের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন। অনেক বিরোধিতার পর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সিওয়ার্ডের সাত দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার বা ৭২ লাখ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব অনুমোদন করে।
১৮৬৭ সালের ১৮ই অক্টোবর আলাস্কার তৎকালীন রাজধানী সিতকায় যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। সমালোচকরা যারা এই জমির কোনো মূল্য নেই বলে বুঝতে পেরেছিলেন, তারা আলাস্কা কেনাকে শুরুর দিকে 'সিওয়ার্ডের বোকামি' বলে অভিহিত করেছিলেন। মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী হিসাব করলে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া সাত দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার এখনকার দিনে একশ মিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম অঙ্গরাজ্যের জন্য যা বর্তমানে উল্লেখযোগ্য রকম কম দাম।
ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকে আলাস্কায় সোনা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের খোঁজ মিলতে শুরু হয় যেটি শিগগিরই উল্লেখযোগ্য লাভ আনতে থাকে। সিওয়ার্ডের এই পদক্ষেপ ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয় এবং ১৯৫৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস আলাস্কায় ১২ হাজারেরও বেশি নদী এবং ব্যাপক সংখ্যক লেক আছে। আলাস্কার রাজধানী জুনো যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র রাজধানী যেখানে শুধু নৌকা বা বিমানে পৌঁছানো যায়। অ্যাঙ্কোরেজের লেক হুড বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সিপ্লেন ঘাঁটিগুলোর একটি যেখান থেকে দৈনিক প্রায় ২০০টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়।
এই রাজ্যের সবচেয়ে বৃহৎ সামরিক স্থাপনা ও যৌথ ঘাঁটি এলমেনডর্ফ – রিচার্ডসনে সাক্ষাৎ করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পুতিন। আর্কটিক সামরিক প্রস্তুতির জন্য ৬৪ হাজার একরের এই ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ঘটনায় আলাস্কা এবারই প্রথম কেন্দ্রবিন্দুতে এলো, তেমন নয় বিষয়টা। ২০২১ সালের মার্চে অ্যাঙ্কোরেজে জো বাইডেনের সদ্য গঠিত কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা দল চীনাদের সাথে বৈঠক করেছিল।
পুতিনের বৈঠক নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু হোয়াইট হাউস জানিয়েছে আলাস্কার এবারের আলোচনা ট্রাম্পের জন্য একটি ‘লিসেনিং এক্সারসাইজ বা শ্রবণের অনুশীলন’ হবে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে ‘কীভাবে যুদ্ধের অবসান করা যাবে সে সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা দেবে’।
গত সপ্তাহে এই বৈঠকের ঘোষণা দেয়ার সময় ট্রাম্পকে আশাবাদী শোনাচ্ছিল এ বিষয়ে যে এই বৈঠক শান্তির দিকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের পথ খুলে দিতে পারে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আগেই বলেছেন, কিয়েভের অংশগ্রহণ ছাড়া যে কোনো চুক্তিই হবে ‘ডেড ডিসিশন’ বা অচল সিদ্ধান্ত।
তথ্যসূত্র : আল-জাজিরা ও সিএনএন।
বিডি-প্রতিদিন/শআ