দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। মাগুরার আট বছর বয়সি শিশুটির ধর্ষণ এবং হত্যা ঘটনায় পুরো দেশ যখন ক্ষোভে ফুঁসছে সে সময়ও একের পর এক শিশু ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসছে। এসব ঘটনায় দেখা যায়, শিশুটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতদের মাধ্যমে জঘন্য এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, কম বয়সি শিশুদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করা হচ্ছে। আর আশপাশের পরিচিতরাই শিশুদের ধর্ষণ করছে। এক্ষেত্রে সৎ বাবা, চাচা, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীরা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। শিশুদের ক্ষেত্রে খাবারের লোভ দেখিয়ে আবার কিছু ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছে কমপক্ষে ৯ হাজার ৬৭৭ শিশু। এদের বয়স ১৮ এর কম। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮০১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত আট বছরে ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ৬ বছরের কম। আর ১ হাজার ২৮ জনের বয়স সাত থেকে ১২। গত আট বছরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৪০ শিশুকে। এর মধ্যে ৩৩ শিশুর বয়স ৬ বছরের কম। আর ৯৮ জনের বয়স সাত থেকে ১২। সাভারের আশুলিয়ার দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে তাদের সৎ বাবার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে আশুলিয়ার গণকবাড়ি এলাকায় এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন তার মা। এই ঘটনায় গত ৯ মার্চ ১০ বছরের মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি পালিয়ে যায়। আরেক ঘটনায় আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মেয়েকে ধর্ষণ করে তার সৎ বাবা। এর আগেও মেয়েকে ধর্ষণ করেছে অভিযুক্ত ব্যক্তি। তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে পঞ্চগড়ে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ১২ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত শরিফুল ইসলাম শিশুটির প্রতিবেশী। জানা যায়, ঘটনার দিন শিশুটি বাসার সামনে খেলছিল। সে সময় শরিফুল শিশুটিকে তার ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে মো. ইব্রাহিম নামে মুদি দোকানির বিরুদ্ধে। শিশুটির বাসার পাশেই একটি মুদি দোকানে বসে ইব্রাহিম। গত ১৩ মার্চ দুপুরে খেলতে খেলতে মুদি দোকানের সামনে গেলে ইব্রাহিম তাকে দোকানের ভিতরে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ২০ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে জহুরুল ইসলাম সাগর নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ১৩ মার্চ বিকালে এই ঘটনা ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা ধর্ষকদের এই নিন্দনীয় কাজে উদ্দীপ্ত করছে। একজন মানুষ যদি অনবরত পর্নো দেখে তখন তার মনে এই বিষয়গুলোই ঘুরে বেড়ায়। তখন যে কোনো বয়সি মেয়ে ও নারীদের নিয়ে এইসব মানুষ এক ধরনের অবাস্তব সেক্স্রুয়াল ওরিয়েন্টেড হয়ে পড়ে এবং তার মধ্যে সেই চিন্তাই প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। আর এই সাইকোলজিক্যাল আবহ তখন সেই মানুষদের ধর্ষণে উসকে দেয়। ‘বাংলাদেশের নারী ও কন্যা নির্যাতন চিত্র ২০১৯; ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় পরিচিত মানুষ, নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশীর দ্বারা। প্রতিবেশীর মাধ্যমে একটি বড় অংশ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ হার ধর্ষণের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ আর গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ১৮ শতাংশ। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দুই বছরের কম বয়সি শিশুও প্রতিবেশীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী শিরীন পারভিন হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাজ মনে করে নারীর দেহের ওপর তার খবরদারি করার অধিকার আছে। ছেলেশিশুরাও কিন্তু যৌন হয়রানির শিকার হয়। তবে কন্যাশিশুদের তুলনায় সংখ্যায় কম হয়। কন্যাশিশুটিকেও নারীর মতো করেই সমাজে দেখা হয়। এই শিশুকে আক্রমণ করার জন্মগত অধিকার পুরুষের আছে- এমনটি অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে সেই পুরুষরা এমন মনে করেন যারা মেয়েটির তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাবান। ধর্ষণের মতো অপরাধ করে আমাদের দেশে পার পেয়ে যাওয়ার রীতি আছে বলেই ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটে। আর অপরাধীদের পার পাওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। এর একটি হচ্ছে পুলিশের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আলামত সংগ্রহ, সংরক্ষণ করা এবং সঠিকভাবে তা আদালতে পেশ করায় পুলিশের দক্ষতার বিষয়টি সামনে আসে। এ ছাড়া সমাজও এ ধরনের ঘটনায় প্রথমে মেয়েটির দিকে আঙুল তোলে। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকেই উল্টো দোষ দেওয়া হয়।