শুধু আম, কাঁসা ও রেশম শিল্পেই নয়; চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদেও সমৃদ্ধ একটি জেলা। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের অবস্থান শিবগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে ৫০০ বছর আগে সুলতানি আমলে নির্মিত সুলতানি স্থাপত্যের রত্নখ্যাত ছোট সোনামসজিদ। এ ছাড়া এ এলাকার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ও দর্শনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে সেন বংশের শেষ রাজাদের স্মৃতিচিহ্ন। জানা যায়, ভারতের মালদহ জেলার মোহদীপুরে সুলতানি স্থাপত্যের অনুরূপ একটি মসজিদ থাকায় সেটিকে বড় সোনামসজিদ এবং শিবগঞ্জের মসজিদকে ছোট সোনামসজিদ বলা হয়। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর কোয়াটার্সের তোহাখানা কমপ্লেক্স থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণ-পুবে বিশাল এক দিঘির পাশে অবস্থিত এ ছোট সোনামসজিদ। মসজিদের প্রধান প্রবেশপথের উপরিভাগে স্থাপিত শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদটি মজলিস-ই-মাজালিস মনসুর ওয়ালি মুহাম্মদ বিন আলি কর্তৃক নির্মিত হয়। শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখসংবলিত অক্ষরগুলো মুছে গেলেও এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের নাম উল্লেখ রয়েছে। তাই ধারণা করা হয়, তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো একসময় এ মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী সবাইকে মুগ্ধ করে। মসজিদের দরজাগুলো শোভাবর্ধক রেখা দিয়ে ঘেরা থাকলেও এর খুব কাছে না গেলে এর খোদাই কাজ চোখে পড়ে না। মসজিদের সামনের দিকে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে তিনটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে উপরিভাগে দোতলার আদলে নির্মিত একটি রাজকীয় গ্যালারি রয়েছে; যা ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় আজও বিদ্যমান। এর উত্তর-পশ্চিম কোণে গ্যালারির প্রবেশপথ রয়েছে। এর সামনে রয়েছে একটি মিহরাব। মসজিদটির অলংকরণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালি ব্যবহৃত হয়েছে। মসজিদের শিলালিপিটির বাংলা অনুবাদে দেখা যায়, এতে লেখা রয়েছে, ‘দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ ও বিচার দিনের ওপর আর কাউকে ভয় করো না। যারা আল্লাহর মসজিদ তৈরি করে, তারা শিগগিরই পথ প্রদর্শিতদের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহর জন্য যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে, তার জন্য অনুরূপ একটি ঘর বেহেশতে তৈরি করা হবে।’ এতে আরও লেখা রয়েছে, ‘এ মসজিদের নির্মাণকাজ সুলতানগণের সুলতান, সৈয়দগণের সৈয়দ, পবিত্রতার উৎস, যিনি মুসলমান নরনারীর ওপর দয়া করেন, যিনি সত্য কথা ও সৎ কাজের প্রশংসা করেন, যিনি ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষক, সেই আলাউদ্দুনিয়া ওয়াদ্দিন আবুল মুজফ্ফর হুসেন শাহ সুলতান আল হুসাইনির (আল্লাহ তাঁর রাজ্য ও শাসন চিরস্থায়ী করেন) রাজত্বকালে সংঘটিত হয়। খালেস ও আন্তরিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে ওয়ালি মনসুর কর্তৃক জামে মসজিদ নির্মিত হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানে তাঁকে সাহায্য করেন। এর শুভ তারিখ হচ্ছে রহমতের মাস রজবের ১৪ তারিখ। এর মূল্য ও মর্যাদা বর্ধিত হোক।’ এ লিপিটির মধ্যের লাইনে তিনটি শোভাবর্ধক বৃত্ত রয়েছে। মসজিদটি অলংকরণের ক্ষেত্রে সোনালি গিল্টির (রঙের) ব্যবহার থেকে মসজিদটির নামকরণ সোনামসজিদ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সেই গিল্টি এখন আর নেই। এ ছাড়া মসজিদের চারদিকে একটি পুরু দেয়াল ছিল। পূর্ব-পশ্চিমে ৪২ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪৩ মিটার লম্বা এ বহির্দেয়ালের পুব দিকের মধ্যবর্তী স্থানে একটি প্রধান ফটক ছিল। কিন্তু কালের আবর্তে প্রধান ফটকটি ছাড়া বহির্দেয়াল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে ভগ্নচিহ্ন আজও বিদ্যমান। এ মসজিদটি ইট ও পাথরে নির্মিত। মসজিদের বাইরের দেয়ালে এবং ভিতরে গ্রানাইট পাথরখে র আস্তরণ রয়েছে। জানা যায়, ১৮৯৭ সালে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে ধ্বংসলীলার পর সংস্কারের সময় পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ অংশে পাথরের আস্তরণ অপসারিত হয়েছে। মসজিদের বাইরের দিকে চার কোণে চারটি বহুভুজাকৃতির বুরুজের সাহায্যে কোণগুলো মজবুত করা হয়েছে। সোনামসিজদের প্রধান ফটকের প্রায় সাড়ে ১৪ মিটার পুব দিকে একটি পাথরের প্ল্যাটফরম রয়েছে, যার আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪.২ মিটার, পূর্ব-পশ্চিমে ৬.২ মিটার এবং উচ্চতা ১ মিটার। এর চার কোণে একটি করে প্রস্তরস্তম্ভ রয়েছে। এখানে কয়েকটি বাঁধানো কবর রয়েছে। কিন্তুকারা সমাহিত আছেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে দুটি সমাধিতে কোরআনের আয়াত ও আল্লাহর কিছু নামসংবলিত পাথরের সমাধিফলক রয়েছে। ইতিহাসবিদ ক্যানিংহ্যামের মতে সমাধি দুটি হচ্ছে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালি ও তাঁর বাবা আলির। গৌড়ের ঐতিহ্যবাহী এ ছোট সোনামসজিদ দেখতে সারা বছর পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। দেশের যে কোনো স্থান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসার পর সোনামসজিদ যাওয়ার জন্য সরাসরি বাস সার্ভিসসহ অন্যান্য যানবাহন রয়েছে। এ ছাড়া পর্যটকের জন্য এখানে গড়ে তোলা হয়েছে মোটেল।