ইসলামী শরিয়ত হলো, সেই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন কী মানতে হবে, কী থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কোনটা হালাল আর কোনটা হারাম। শাব্দিকভাবে ‘শরিয়ত’ শব্দের অর্থ হলো এমন পথ বা উৎস, যেখানে আরোহী বা পানকারী পানি পান করে। আল্লামা ইবনু হাজম (রহ.) বলেন, ‘শরিয়ত হলো সেই সব বিধান, যা আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর পূর্ববর্তী নবীদের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য প্রণয়ন করেছেন।’
(আল-আহকাম : ১/৪৬)
শরিয়ত হলো দ্বিন ইসলামের বিশ্বাস এবং কর্মগত সব বিধি-বিধানের সমষ্টি, যা আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষের কাছে ওহির মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। যাতে মানুষ তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তা কর্মে বাস্তবায়ন করে।
শরিয়তের অনন্য বৈশিষ্ট্য
প্রথমত : শরিয়ত হলো ইসলাম, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বিনকে পরিপূর্ণ করেছি, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বিন হিসেবে মনোনীত করেছি।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩)
শরিয়া হলো সেই সব বিধান ও আইন-কানুন, যা আল্লাহ তাঁর কিতাব কোরআনে এবং তাঁর রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন।
দ্বিতীয়ত : শরিয়ত হলো আল্লাহর ওহি (প্রত্যাদেশ),
শরিয়তের ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক সবই মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি বা প্রত্যাদেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এভাবেই আমি তোমার প্রতি আমার ওহি (প্রত্যাদেশ) প্রেরণ করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী, কিন্তু আমি এটিকে এক আলো বানিয়েছি, যার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে পথ প্রদর্শন করি।’ (সুরা : শূরা, আয়াত : ৫২)
সুতরাং শরিয়ত কোনো মানবসৃষ্ট ব্যবস্থা নয়; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এমন এক ঐশী দিকনির্দেশনা, যা কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে মানবজাতিকে সত্য, ন্যায় ও মুক্তির পথে পরিচালিত করে।
তৃতীয়ত : শরিয়াত হলো পরম সত্য,
শরিয়ত হলো সেই ঐশী প্রত্যাদেশ—যা পরম সত্য, সম্পূর্ণ নির্ভুল ও বিকৃতিমুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার সম্প্রদায় এটি অস্বীকার করেছিল, অথচ এটি তো সত্য।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৬৬)
সুতরাং শরিয়ত এমন এক পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত সত্য, যার প্রতিটি বাক্য ও বিধান আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে উদ্ভূত। এতে কোনো মিথ্যা, বিভ্রান্তি বা বৈপরীত্যের স্থান নেই।
চতুর্থত : শরিয়ত সম্পূর্ণ নিখুঁত ও চিরসংরক্ষিত,
শরিয়ত কখনো বিকৃতি, সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন হবে না।
কারণ এর মূল উৎস কোরআনুল কারিম, যা আল্লাহর সংরক্ষণে আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই, আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং অবশ্যই আমিই এর সংরক্ষক।’
(সুরা : হিজর, আয়াত : ৯)
আল-কোরআন এমন এক পরিপূর্ণ গ্রন্থ, যা বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা থেকে মুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটি একটি কিতাব, যার আয়াতগুলো সুসংগঠিতভাবে পরিপূর্ণ করা হয়েছে এবং পরে প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।’
(সুরা : হুদ, আয়াত : ১)
সুতরাং শরিয়ত হলো এক পরিপূর্ণ ও সংরক্ষিত বিধান, যার সত্যতা ও বিশুদ্ধতা আল্লাহর নিজস্ব প্রতিশ্রুতিতে অটল।
পঞ্চমত : শরিয়তের প্রতি আনুগত্য ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ বাধ্যতামূলক; যেহেতু শরিয়াহ মূলত স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত, তাই একজন মুসলিমের জন্য একমাত্র করণীয় হলো এর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, সম্মান এবং নির্বিচারে আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন : ‘কখনোই নয়! তোমার প্রতিপালকের শপথ, তারা প্রকৃত অর্থে ঈমান আনবে না যতক্ষণ না তারা তোমাকে (হে মুহাম্মদ) তাদের পারস্পরিক বিরোধের বিষয়ে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করে এবং তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোনো সংকোচ না পায়, বরং সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৬৫)
ষষ্ঠত : শরিয়ত আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও দাসত্বের প্রকাশ; শরিয়াহর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত প্রতিষ্ঠা করা—বাহ্যিক কর্মে এবং হৃদয়ের অন্তরঙ্গ অনুভূতিতেও। শরিয়াহ মানুষকে শেখায়, সে যেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণভাবে দাসত্ব ও আনুগত্য প্রকাশ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবজাতি! তোমাদের প্রভুর ইবাদত করো।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২১)
সুতরাং শরিয়ত হলো এমন এক জীবনব্যবস্থা, যা মানুষকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
সপ্তম : শরিয়ত অনুসরণ করা এক অবিচ্ছেদ্য কর্তব্য;
যেহেতু শরিয়াহ এত মহান, পূর্ণাঙ্গ ও সত্যনিষ্ঠ, তাই এর বিধান, আয়াত ও প্রমাণিত হাদিসের বিরোধিতা করা কারো পক্ষেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক হলো শরিয়াহর নির্দেশ মেনে চলা ও তার অনুসরণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর আমি তোমাকে একটি সুস্পষ্ট শরিয়তের পথে স্থাপন করেছি; তাই তুমি সেই পথ অনুসরণ করো।’
(সুরা : জাসিয়াহ, আয়াত : ১৮)
তাই শরিয়াহর প্রতি আনুগত্যই হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একমাত্র উপায়। এ কারণেই মুমিনের প্রকৃত মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার আনুগত্যে—সে কতটা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর বাণী অনুসারে জীবন পরিচালনা করছে।
অষ্টম : শরিয়ত অর্থে স্পষ্ট, ব্যাখ্যায় বিশদ ও পূর্ণাঙ্গ;
শরিয়ত এমন এক দিব্য বিধান, যার প্রতিটি আয়াত স্পষ্ট, সুস্পষ্ট ও নির্ভুল। এর বাণীগুলো এমনভাবে অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে সত্য অনুসন্ধানী মানুষের কাছে দ্ব্যর্থতার কোনো স্থান না থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তোমার প্রতি এই কিতাব নাজিল করেছি, যাতে সব কিছুর স্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে এবং তা মুসলিমদের জন্য পথনির্দেশ, রহমত ও সুসংবাদ।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৮৯)
তাই শরিয়ত শুধু স্পষ্টই নয়, বরং এর ব্যাখ্যা ও বিশদ বিশ্লেষণ এমনভাবে সংরক্ষিত হয়েছে, যাতে হালাল ও হারামের সীমা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
নবম : মানবজাতির কল্যাণ ও স্বার্থ রক্ষায় শরিয়া যথেষ্ট;
শরিয়তের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি মানবজাতির ইহকাল ও পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই স্বার্থ রক্ষায় সম্পূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এটি মানুষকে সর্বাপেক্ষা সরল পথ দেখায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই কোরআন সর্বাধিক সরল পথের দিকে পরিচালিত করে এবং সৎকর্মশীল বিশ্বাসীদের জন্য সুসংবাদ দেয় যে তাদের জন্য মহান প্রতিদান রয়েছে।’ (সুরা : ইসরা, আয়াত : ৯)
দশম : শরিয়াহ প্রতিটি মুসলিমের পরিচয় ও মর্যাদা নির্ধারণকারী; শরিয়াহ একজন মুসলিম পুরুষ বা মহিলাকে সঠিক পরিচয় ও মর্যাদা প্রদান করে, যা শুধু তাকওয়া (আল্লাহভীতি ও ধার্মিকতা) দ্বারা নির্ধারিত হয়, জাতি, বর্ণ বা সামাজিক অবস্থার দ্বারা নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি তোমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন