মহান আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির অবধারিত নীতি হলো, সৃষ্টিগতভাবে মানুষ-মানুষে পার্থক্য। তবে তাঁর এমন কিছু সৃষ্টিও আছে যারা সৃষ্টিতে একেবারেই এক ও অভিন্ন। যেমন ফেরেশতারা। আবার এমন কিছু সৃষ্টিও আছে, যারা পরিবর্তন কিংবা বৈচিত্র্য গ্রহণে সক্ষম নয়, যেমন জড় বস্তু।
সুতরাং, মানব সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য বা পার্থক্য সৃষ্টি করা আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরতেরই বহিঃপ্রকাশ এবং তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ পরিকল্পনারই অংশ। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আর যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন, তবে তিনি অবশ্যই সমগ্র মানবজাতিকে একটি জাতি বানিয়ে দিতেন। কিন্তু তারা সব সময় পরস্পর ভিন্ন হয়ে থাকবে তাদের ছাড়া, যাদের প্রতি তোমার রব দয়া করেছেন। আর এ জন্যই তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১১৮-১১৯)
এই আয়াতের শেষাংশে ‘এবং এ জন্যই তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন’ এর অর্থ হলো আল্লাহ মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ভাষা, রং, মেধা, চিন্তা ও পথ অনুসরণের সক্ষমতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। এটাই সৃষ্টির মূল রহস্য ও সৌন্দর্য। আমরা মহাবিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই বৈচিত্র্য ও পার্থক্য সবকিছুতেই বিদ্যমান। এই পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে দ্বৈততার ভিত্তিতে।
কখনো অনুভূতিতে যেমন, সুখ ও দুঃখ, সন্তুষ্টি ও রাগ, আবার কখনো সৃষ্টি জগতে যেমন-আকাশ ও পৃথিবী, স্থল ও সমুদ্র। মানুষের মধ্যেও এটি বিদ্যমান-পুরুষ ও নারী, ধনী ও গরিব, বুদ্ধিমান ও সাধারণ, লম্বা ও খাটো, শক্তিশালী ও দুর্বল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আমি সবকিছুর জোড়া সৃষ্টি করেছি, যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৪৯)
আল্লাহ তাআলা মানুষসহ সকল সৃষ্টির মাঝে এই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন, যেন মানুষ তা দেখে, চিন্তা করে এবং তাঁর অসীম কুদরত উপলব্ধি করতে পারে। সুতরাং, সৃষ্টির প্রতিটি স্তরে যে পার্থক্য দেখা যায়, তা এক মহান স্রষ্টার সূক্ষ্ম পরিকল্পনারই অংশ।
কেননা মানুষ সমাজবদ্ধ জীব-নিজের একদিনের প্রয়োজনও একা পূরণ করতে পারে না। ছুতার, রুটিকার, কৃষকসহ নানাজনের সহযোগিতায় তার জীবন চলে। তা ছাড়া মানুষের দক্ষতার ক্ষেত্রেও আছে বৈচিত্র্য ও পার্থক্য। কেউ হয়তো লোহার কাজে দক্ষ, কিন্তু কাঠের কাজে নয়। কেউ আবার চিকিৎসায় পারদর্শী, কিন্তু কৃষিকাজে নয়। এই পার্থক্যই সমাজে বিভিন্ন শিল্প ও পেশার জন্ম দিয়েছে। এভাবেই মানুষের মধ্যে থাকা ভিন্নতা ও পার্থক্য বাস্তবিক অর্থেই এক রহমত হয়ে উঠেছে। কারণ এই বৈচিত্র্য সমাজে দায়িত্ব ভাগাভাগি করেছে, একে অপরের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছে এবং একটি পরস্পর-সম্পৃক্ত ও সমন্বিত সমাজ গঠনের পথ খুলে দিয়েছে—যার মাধ্যমে পৃথিবী আবাদ ও সমৃদ্ধ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতেই বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৬১)
মানুষের মাঝে যে বৈচিত্র্য ও পার্থক্য বিদ্যমান—সুস্থতা ও অসুস্থতা, দারিদ্র্য ও সম্পদ, নিরাপত্তা ও দুর্দাশা—শুধু সমাজগত বাস্তবতা নয়; বরং তা একেকজন ব্যক্তির ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষাও।আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তোমাদের একজনকে অন্যজনের জন্য পরীক্ষা বানিয়েছি, তোমরা কি ধৈর্য ধরবে?’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ২০)
আল্লাহ আমাদের কারো কারো জীবনে কষ্ট দেন, আবার কাউকে দেন আরাম। কেউ হয়তো রোগে ভোগে, আর কেউ সুস্থতায় দিন কাটায়। কেউ অর্থে সচ্ছল, আবার কেউ অভাবী। এই পার্থক্যগুলোই মানুষের ঈমান যাচাইয়ের এক একটি উপায়। রাসুল ( সা.) বলেন, ‘পুরস্কারের মহত্ব নির্ভর করে পরীক্ষার কঠিনতার ওপর। আর আল্লাহ যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তাদের পরীক্ষা করেন। যে এতে সন্তুষ্ট থাকে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে; আর যে অসন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য রয়েছে অসন্তোষ।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৫১০)
আর প্রতিটি অবস্থার উদ্দেশ্য একটাই—আল্লাহ দেখতে চান, কে ধৈর্য ধরে, কে কৃতজ্ঞ থাকে, আর কে তাঁর ওপর সন্তুষ্ট থাকে।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে পুরুষ ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তাদের মাঝে বিদ্যমান পার্থক্যের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্কের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ হয়। এই বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমেই জন্ম হয় সন্তান-সন্তুতির, যা মানবজাতির ধারাবাহিকতা ও বংশ রক্ষাকে নিশ্চিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। নিঃসন্দেহে আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৩)
নারী-পুরুষের এই পার্থক্য ও পরিপূরকতা শুধু দাম্পত্য জীবনের জন্যই নয়; বরং তা একটি পরিবার গঠনের ভিত্তি। এই পরিবার থেকেই গড়ে ওঠে সমাজ, সম্প্রদায় এবং একটি জনশক্তিশালী জাতি। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য, এই বৈধ দাম্পত্য সম্পর্ক ও বংশবৃদ্ধি শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়; বরং এটি ইবাদতের অংশও বটে, যার মাধ্যমে আল্লাহর জমিনে নেককার ও আল্লাহভীরু মানুষের সংখ্যা বাড়ে, এবং পৃথিবীর শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন সম্ভব হয়।
মানুষের মধ্যে বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বার্থের দিক থেকে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ইসলাম একটি আশ্চর্যজনক নীতির মাধ্যমে সেই পার্থক্যকে ঐক্যে রূপান্তর করেছে, তা হলো ভ্রাতৃত্ব। ইসলামী সমাজে এই ভ্রাতৃত্ববোধ মানুষকে একটি অভিন্ন একক ইউনিটে পরিণত করে। যার প্রতিটি অংশ অন্যটির জন্য সহানুভূতিশীল ও সহায়ক। রাসুল (সা.) বলেন : ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া এবং সহানুভূতির দিক থেকে মুমিনদের উদাহরণ একটি দেহের মতো। যদি দেহের কোনো একটি অংশ কষ্ট পায়, তাহলে পুরো দেহই জেগে উঠে ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১১)
সুতরাং, মানুষের মাঝে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আলোয় তারা একত্র হয়। এটাই হলো ইসলামের সেই অপূর্ব নীতি, যা বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সুর তোলে এবং একটি সহানুভূতিশীল, পরস্পর-সহযোগিতাপূর্ণ সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। রাসুল (সা.) বলেন : ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা চায়, তা-ই তার ভাইয়ের জন্যও না চায়।’ (বুখারি, হাদিস : ১৩)
এই পারস্পরিক ভালোবাসা, সহযোগিতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ গড়ে ওঠে।
সুতরাং পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় বৈচিত্র্যময় সুনিপুন এই সৃষ্টির মধ্যেই নিহিত স্রষ্টার অনুপম সুপরিকল্পিত রহস্য।