আজ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি দখলদাররা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
মানুষ হত্যাকে ইসলামে জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে তারা জঘন্য অপরাধী। গণহত্যা আরও বড় অপরাধ। আল্লাহতায়ালার যত সৃষ্টি রয়েছে এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে মানুষ। মানবসৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ ফেরেশতাদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেছেন এবং মানুষকে এই জমিনে তাঁর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন তারা বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জানো না (সুরা বাকারা, আয়াত ৩০)।’ মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ মানুষকে তাদের দান করেছেন সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।’ সুরা তিন, আয়াত ৪। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী হচ্ছে, এই বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন কেবল মানুষেরই জন্য। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য জমিনের সবকিছু (সুরা বাকারা, আয়াত ২৯)।’ আল্লাহ যেমন ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানবজাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছেন। একজন মানুষের জীবন, সম্পদ, মানসম্মান আল্লাহর কাছে এত দামি যে, কোরআন ও হাদিসে এসব বিষয়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল কোরআনে একজন মানুষ হত্যা করাকে গোটা মানবজাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
স্বাধীনতা মহান আল্লাহর নিয়ামত। আরবি ভাষার প্রবচন- ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’। জন্মভূমি মক্কার প্রতি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপরিসীম ভালোবাসার কথা বিশ্ববাসীর জানা। প্রতিপক্ষ মুশরিকদের হিংস্রতার শিকার হয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যেতে বাধ্য হন। তিনি যখন মদিনার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন তখন পেছন ফিরে প্রিয় মাতৃভূমির দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে প্রিয় জন্মভূমি মক্কা আমার! যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বাধ্য না করত আমি কোনো দিন তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা আমরা পেয়েছি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে। সে অর্থে জন্মভূমিকে ভালোবাসা রসুলের সুন্নত। তাফসিরে কুরতুবির বর্ণনা অনুযায়ী- যখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করছিলেন তখন তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠেছিল। দেশের জন্য, জন্মভূমির জন্য তাঁর দরদ ও ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। পরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবিবের মাধ্যমে মক্কাকে মুশরিকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে, স্বাধীনতা দিয়ে ধন্য করেছেন। হাদিসের বর্ণনায় আছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনাকেও খুব ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজির চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত এবং তিনি বলতেন, ‘এ ওহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও ওহুদকে ভালোবাসি (বুখারি, মুসলিম)।’
হিজরতের পর মদিনায় হজরত আবুবকর (রা.) ও বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাঁদের মনে প্রিয় স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তাঁরা জন্মভূমি মক্কার কথা স্মরণ করে আবেগে আপ্লুত হয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের মনের এ দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি তেমন মদিনার ভালোবাসা তার চেয়েও বেশি আমাদের অন্তরে দান করুন।’ বুখারি। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে স্বদেশকে ভালোবেসে আমাদের জন্য দেশপ্রেমের আদর্শ রেখে গেছেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি কেউ তোমাদের কোনো উপকার করে তবে তাকে প্রতিদান দেবে। যদি প্রতিদান দিতে না পারো তবে তার জন্য এমনভাবে দোয়া করবে, যেন তোমাদের মন সাক্ষ্য দেয়, হ্যাঁ তোমরা তার প্রতিদান দিয়ে দিয়েছ (আবু দাউদ)।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর তবে তা শেষ করতে পারবে না (সুরা নাহল আয়াত ১৭)।’ আল্লাহর দেওয়া অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ নেয়ামত হলো স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মানুষ দুই যুগের দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহর এ নেয়ামত অর্জন করেছে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন মহান আল্লাহর কাছে এই দিনে আমরা তাদের জন্য দোয়া করব। আল্লাহ তাদের বেহেশতের সুশীতল স্থানে ঠাঁই দিন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক
বিডি প্রতিদিন/এমআই