রমজান নিছক সিয়াম সাধনার মাস নয়, বরং আত্মশুদ্ধির এক মহিমান্বিত অধ্যায়। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অফুরন্ত রহমতের বারিধারা, যেখানে নবী করিম (সা.) আরো গভীরভাবে আত্মনিমগ্ন হতেন ইবাদত-বন্দেগিতে। অন্যান্য সময়েও তিনি ছিলেন পরম ধার্মিক ও উদার, কিন্তু রমজানে তাঁর ইবাদত ও দানশীলতা যেন সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো বিস্তৃত হয়ে যেত। এই পবিত্র মাসে তিনি কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির-আজকারে এতটাই ডুবে যেতেন যে সময় যেন থমকে দাঁড়াত।
বিশেষত জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে কোরআন তিলাওয়াত ছিল এক অনন্য রেওয়াজ। ইবন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সবার চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমজানে জিবরাইল (আ.) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন।
আর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে কোরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। জিবরাইল (আ.) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০২; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩০৮)
এই মাসে তিনি শুধু নিজের ইবাদতেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না, বরং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করতেন নেক আমলের পথে। তিনি মনে করিয়ে দিতেন, রোজা শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করার নাম নয়, বরং আত্মাকে সংযত রাখার অন্যতম উপায়।
তাই অশ্লীল বাক্য, মিথ্যা, কলহ-বিবাদ, গালাগাল ও পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও তদানুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ করল না, তবে তার খাওয়াদাওয়া পরিত্যাগ করা আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য রাখে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)
মূলত রমজান হলো সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাস। তাই নবী করিম (সা.) একে তুলনা করেছেন ঢালের সঙ্গে, যা মানুষকে পাপ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু যদি কেউ নিজেই তার রোজাকে কলুষিত করে, তবে এই ঢাল আর কার্যকর থাকে না।
তিনি বলেন, রোজা এক প্রতিরক্ষার ঢাল, যতক্ষণ না কেউ নিজেই তা বিদীর্ণ করে ফেলে। (সুনানে দারিমি, হাদিস : ১৭৩২)
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, রোজা ঢালস্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৯৪)
তবে রোজা যেন কেবল ক্ষুধা ও ক্লান্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে তিনি গভীরভাবে সতর্ক করতেন। একবার তিনি বলেছিলেন, অনেক রোজাদার আছে, যারা তাদের রোজার বিনিময়ে কেবল ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারে না। আবার অনেক রাতজাগা ইবাদতকারী আছে, যারা শুধু নিদ্রাহীন রাতের ক্লান্তি ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না।
(সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস : ১৯৯৭)
রমজানের দীর্ঘ সময় ধরে উপবাস থাকা কখনো কখনো কষ্টকর হয়ে উঠত, কিন্তু নবীজি (সা.) এই কষ্টকে কখনোই বাধা হতে দিতেন না। কখনো মাথায় পানি ঢেলে নিজেকে স্নিগ্ধ করতেন, কখনো গোসলের মাধ্যমে ক্লান্তি দূর করতেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৩৬৫)
এতে প্রমাণিত হয়, রোজার মূল উদ্দেশ্য আত্মসংযম ও ইবাদতে মনোযোগী হওয়া, শারীরিক কষ্টে নিজেকে বিপর্যস্ত করা নয়।
রমজানের রাত
রমজানের রাতগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.) অশেষ নিয়ামত হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনি এই মহিমান্বিত রাতগুলোর বেশির ভাগ সময় তাহাজ্জুদ ও তারাবির ইবাদতে অতিবাহিত করতেন এবং সাহাবাদেরও এর প্রতি উৎসাহ দিতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের প্রত্যাশায় রমজানে রাত জেগে ইবাদত করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৭)
যে মহামানব তাঁর সাহাবাদের এত আন্তরিকতার সঙ্গে ইবাদতের প্রতি উৎসাহিত করতেন, তাঁর নিজের আমল কত গভীর ও নিবেদিত ছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়! তদুপরি, রমজানের বাইরেও তাঁর নিয়মিত তাহাজ্জুদের অভ্যাস ছিল।
এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে রমজানের প্রথম ২০ রাত এবং শেষ ১০ রাতের ইবাদতের মধ্যে পার্থক্য ছিল। প্রথম ২০ দিনে তিনি ইবাদতের পাশাপাশি বিশ্রাম নিতেন এবং পরিবারের প্রতি যথাযথ হক আদায় করতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রথম ২০ রাতে কিছু সময় ঘুমাতেন এবং কিছু সময় নামাজ পড়তেন। কিন্তু যখন শেষ ১০ রাত আসত, তখন তিনি ইবাদতে আরো বেশি মনোনিবেশ করতেন এবং কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নিতেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০১)
এ ছাড়া তিনি রমজানের শেষ ১০ রাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। আয়েশা (রা.) আরো বলেন, যখন শেষ ১০ রাত আসত, তিনি পূর্ণরূপে ইবাদতে নিমগ্ন হতেন, রাত জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সদস্যদেরও জাগিয়ে দিতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৪, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৭৪)
তিনি কখনো কখনো শেষ দশকে জামাতে তারাবি আদায়ের ব্যবস্থা করতেন, তবে এটি নিয়মিত করতেন না, যাতে উম্মতের ওপর তা ফরজ হয়ে না যায়।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩১)
ইতিকাফ ও লাইলাতুল কদর
আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকে নিয়মিত ইতিকাফ করতেন। এমনকি কোনো বছরে যদি ইতিকাফ করা সম্ভব না হতো, তবে তিনি পরের বছর তার কাজা আদায় করতেন। (সুনানে আবি দাউদ,
হাদিস : ২৪৬৩, জামে আত-তিরমিজি, হাদিস : ৮০৩)
ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য ছিল লাইলাতুল কদরকে তালাশ করা, যা এক মহিমান্বিত রজনী এবং হাজার মাসের চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ। (সুরা : আল কদর, আয়াত : ৩)
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রথমে রমজানের প্রথম দশকে ইতিকাফ করলেন, এরপর দ্বিতীয় দশকে ইতিকাফ করলেন। এই ইতিকাফ তিনি একটি তুর্কি তাঁবুর ভেতরে করছিলেন, যা মসজিদে তাঁর জন্য নির্মিত হয়েছিল। এরপর একদিন তিনি তাঁবুর ভেতর থেকে তাঁর মাথা বের করে বললেন, ‘আমি প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছিলাম লাইলাতুল কদর সন্ধানের জন্য। তারপর দ্বিতীয় দশকে করলাম, কিন্তু আমাকে জানানো হলো যে লাইলাতুল কদর শেষ দশকে পাওয়া যাবে। সুতরাং যারা আমার সঙ্গে ইতিকাফ করেছে, তারা যেন শেষ দশকেও ইতিকাফ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৭, মুসলিম, হাদিস : ১১৬৭)
যখন রাসুল (সা.) ইতিকাফে বসতেন, তখন তাঁর জন্য মসজিদে একটি নির্দিষ্ট কক্ষ বানানো হতো, যাতে তিনি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করতে পারেন। উক্ত কক্ষকে ‘কুব্বাহে তুরকিয়াহ’ (তুর্কি তাঁবু) বলা হয়েছে উপরোক্ত হাদিসে। তিনি দুনিয়াবি আলাপচারিতা, অপ্রয়োজনীয় কাজ ও লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকতেন। ফজরের নামাজের পর তিনি তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে চলে যেতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৩৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৭৩)
রাসুল (সা.)-এর ইতিকাফের বিছানা বা শয্যা রাখা হতো ‘উসতুওয়ানায়ে তাওবা’র (তাওবার স্তম্ভ) পেছনে।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৭৪)
ইতিকাফের সময় তিনি বিনা প্রয়োজনে ঘরেও প্রবেশ করতেন না, শুধুমাত্র খাওয়া, পান করা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হতেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৯)
লাইলাতুল কদরের সন্ধান
ইতিকাফের দিনগুলোতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন লাইলাতুল কদরের সন্ধানে। তিনি রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবারের সদস্যদেরও জাগিয়ে দিতেন। সাহাবাদেরও এই রাতের প্রতি গুরুত্ব দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমরা লাইলাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে অনুসন্ধান করো।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০১৭)
আল্লাহ তাআলা আমাদের লাইলাতুল কদরের তালাশে শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন