গাজা যুদ্ধ নিয়ে জনমতের বড় পরিবর্তন আঁচ করতে পেরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এখন বোঝা যাচ্ছে, ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বস্ত মিত্র ইসরায়েল এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হলেও তাতে শঙ্কিত নয় দেশটি।
১১ আগস্ট অস্ট্রেলিয়া সরকার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এর কয়েক দিন আগে সিডনির বিখ্যাত হারবার ব্রিজে হাজার হাজার মানুষ গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ত্রাণ সরবরাহের দাবিতে মিছিল করেন। প্রায় দুই বছর আগে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে ঢুকে নজিরবিহীন হামলা চালায়। হামলার প্রতিশোধ নিতে সেদিন থেকেই গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত উপত্যকাটিতে ৬২ হাজার ১৯২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
এদিকে জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি সংস্থা বলেছে, গাজা নগরীতে দুর্ভিক্ষ চলছে। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশেষজ্ঞ মার্টিন কেয়ার বলেন, ইসরায়েলকে অব্যাহত সমর্থন প্রদান এবং সব দোষ হামাসের ঘাড়ে চাপানোর বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির সিদ্ধান্তে ইসরায়েল-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক এমন টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে, যা কয়েক দশকেও দেখা যায়নি। এ ইস্যুতে দুই দেশের শীর্ষ রাজনীতিকেরা একে অপরকে কটাক্ষ করেছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন। পশ্চিম তীরে নিযুক্ত অস্ট্রেলীয় কূটনীতিকদের ভিসা বাতিল করেছে ইসরায়েল। বিপরীতে, একজন ইসরায়েলি আইনপ্রণেতাকে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ইসরায়েলকে অব্যাহত সমর্থন প্রদান এবং সব দোষ হামাসের ঘাড়ে চাপানোর বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। অস্ট্রেলিয়ার একটি শীর্ষ ইহুদি সংগঠন বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তবে সংগঠনটি নজিরবিহীনভাবে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেছে। অস্ট্রেলিয়ার অনেক ইহুদি বলেছেন, এ টানাপোড়েন তাঁদের মনে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা জাগাচ্ছে। কারণ, গত এক বছরে দেশটিতে একাধিক ইহুদিবিদ্বেষী হামলা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু ইহুদিদের কাছে গাজা সংঘাত একটি বিতর্কিত বিষয়। দেশটিতে জনমত জরিপে দেখা গেছে, এ সংঘাতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সেখানকার মানুষের সহানুভূতি বাড়ছে। গত আগস্টে ডেমোসএইউর এক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েল-হামাস শান্তিচুক্তি হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছেন ৪৫ শতাংশ মানুষ। এটি গত বছর ছিল ৩৫ শতাংশ। স্বীকৃতির বিরোধিতা করেছেন ২৩ শতাংশ মানুষ। অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গাজায় দুর্ভিক্ষের ভয়ংকর চিত্র সামনে আসার পর ইসরায়েলের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার জনগণের সহানুভূতি দ্রুত কমতে শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক চার্লস মিলার বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গাজার ছবিগুলো অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতাদের শক্তি জুগিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এগুলো নীতিনির্ধারকদের অনেকের মানসিকতা বদলে দিয়েছে; যেমনটা অন্যান্য দেশেও হয়েছে।’
ইহুদিদের উদ্বেগ : অস্ট্রেলিয়ায় দুই শতাধিক ইহুদি গোষ্ঠীর আমব্রেলা সংগঠন হিসেবে কাজ করে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল অব অস্ট্রেলিয়ান জিউরি। অস্ট্রেলিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপোড়েনে সংগঠনটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি গত বুধবার আলবানিজ ও নেতানিয়াহুকে চিঠি লিখে উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যদি জনসমক্ষে কোনো কিছু বলা লাগে, তবে তা যেন একজন জাতীয় নেতার জন্য মানানসই, সংযত ও মর্যাদাপূর্ণ ভাষায় বলা হয়।’
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়েছে।
গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় উপাসনালয়, ভবন ও গাড়িতে একাধিক ইহুদিবিদ্বেষী হামলা হয়েছে। অনেক ইহুদি আশঙ্কা করছেন, অস্ট্রেলিয়া-ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে এমন হামলার ঘটনাও বাড়তে পারে।
সিডনির নিউটাউন সিনাগগের গুরু এলি ফেল্ডম্যান বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় ইসরায়েলের সমালোচনার দিকে এত বেশি মনোযোগ দিলে এর প্রভাব স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর পড়বে। আমাদের এটা ভেবে দেখা দরকার।’
অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকেই একটি ইহুদি রাষ্ট্রের সমর্থক ছিল। দেশটি আন্তর্জাতিক নানা বিবাদে লম্বা সময় ধরে ইসরায়েলের পাশে ছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের নীতি সমর্থন করে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ দীর্ঘদিন ব্যক্তিগতভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন করলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে এত দিন সতর্ক ছিলেন। জনমতের পরিবর্তনে তাঁর এ অবস্থানও বদল হয়েছে। এ ছাড়া গত মে মাসে নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জয়ের কারণে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে জনগণের তোপে পড়ার ঝুঁকিও কমে গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে অবস্থিত ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সংঘাত বিশেষজ্ঞ জেসিকা জেনাওয়ার বলেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়েছে।
১১ আগস্টের পর থেকে নেতানিয়াহু একাধিক সাক্ষাৎকার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলবানিজকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছেন। তিনি আলবানিজকে একজন দুর্বল নেতা বলেছেন ও ইসরায়েলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ তুলেছেন।