ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন আবাসিক ভবনে ১২ জুন হামলা চালায় ইসরায়েল। সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করে ইরানও। টানা ১২ দিনের যুদ্ধে উভয় দেশেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে বেশি হতাহত হয়েছে ইরানে। কেননা, দেশটিতে মোসাদ গুপ্তচরদের তৎপরতায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরায়েল। এরপর থেকেই নড়েচড়ে বসেছে ইরানি কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে বহু সংখ্যক ইসরায়েলি গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় গুপ্তচরবৃত্তির সন্দেহে বিপুলসংখ্যক আফগানকেও দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে ইরান। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল ও ইরান গত মাসে যখন সংঘাতে জড়িয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু করে, তখন রাজ্যের হতাশা নিয়ে আনমনে তাকিয়ে ছিলেন আফগান নাগরিক এনায়েতুল্লাহ আসগরি। আফগানিস্তানে অস্থিরতা দেখা দেওয়ার পর ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইরানের পরিস্থিতি এখন বৈরী হয়ে পড়েছে। তেহরানে ভবন নির্মাণকেন্দ্রগুলোতে কাজ কমে গেছে। আর আসগরির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে। হাজার হাজার আফগান নাগরিকের মতো ৩৫ বছর বয়সি আসগরি সম্প্রতি ইরান ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, এ সংঘাত আফগানিস্তানকেও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। দেশটি এমনিতেই মানবিক সংকটে জর্জরিত। পরিবার নিয়ে দীর্ঘ যাত্রা শেষে আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছার পর আসগরি বলেন, একটা ভাড়া বাসা খুঁজে পাওয়াই কঠিন, আর পেলেও ভাড়া খুব বেশি ... কোনো কাজও নেই। তিনি আরও বলেন, তালেবান ২০২১ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এ দেশে ফিরে তিনি কী করবেন, তা জানেন না। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানায়, সংঘাত চলাকালে ইরান প্রতিদিন ৩০ হাজারের বেশি আফগানকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এটি সংঘাতের আগের সময়ের ১৫ গুণ বেশি।
এদিকে সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো মার্কিন হামলায় তেহরানের কর্মসূচি প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গেছে বলে ধারণা করছে পেন্টাগন। আগে ফাঁস হওয়া প্রাথমিক মূল্যায়নে ওয়াশিংটনকে অনেক বেশি সতর্ক দেখা গেলেও মার্কিন সামরিক অভিযান যে ইরানে তাদের লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে পেরেছে পেন্টাগনের সর্বশেষ অবস্থানে তারই আভাস মিলছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। সাংবাদিকদের দেওয়া এক ব্রিফিংয়ে পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পারনেল এই হিসাব তুলে ধরে বলেন, তাদের চূড়ান্ত অনুমান হচ্ছে ‘সম্ভবত দুই বছরের কাছাকাছি’ পিছিয়ে গেছে। তবে এর সমর্থনে তিনি কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করেননি। ‘আমরা তাদের কর্মসূচি অন্তত এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত পিছিয়ে দিয়েছি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা মূল্যায়নে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে,’ ব্রিফিংয়ে বলেন পারনেল। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় গত ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ডজনের বেশি ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাঙ্কার-বিধ্বংসী বোমা ও দুই ডজনের বেশি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। -রয়টার্স
হামলায় স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য প্রতিনিয়ত হালনাগাদ হচ্ছে, সেসব তথ্যের দিকে সবার কড়া নজর রয়েছে। অবশ্য হামলার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তাদের হামলা ইরানের কর্মসূচিকে ‘ধ্বংস করে দিয়েছে’। একই কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে বুধবার পারনেলের ব্রিফিংয়ে। এই ধরনের কোনো মূল্যায়নে পৌঁছাতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাধারণত কয়েক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগে। ‘আমরা যেসব গোয়েন্দা তথ্য দেখেছি, তা আমাদের বিশ্বাস করাচ্ছে যে ইরানের, বিশেষ করে ওই স্থাপনাগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে,’ বলেছেন পারনেল। কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের পারমাণবিক ওয়াচডগ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ উসকে দিয়ে বলেছিলেন, ইরান কয়েক মাসের মধ্যেই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বানাতে পারবে। কিছু বিশেষজ্ঞ সাবধান করে বলেছেন, ইরান সম্ভবত হামলার আগেই তাদের অস্ত্র নির্মাণের কাছাকাছি সক্ষমতার উচ্চ মাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ভূগর্ভস্থ ফোরদো স্থাপনা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে ও লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ইরান তাদের উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে, গোয়েন্দা তথ্যে এমন কোনো ইঙ্গিত সম্বন্ধে তিনি অবগত নন। গত সপ্তাহে মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক মূল্যায়নে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মাত্র কয়েক মাস পিছিয়েছে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ওই মূল্যায়নকে গোনায় না ধরে হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির যে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা জোরের সঙ্গে বলে যাচ্ছিলেন। সম্প্রতি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচিও বলেছেন, মার্কিন হামলায় তাদের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ‘ফরদোতে ঠিক কী হয়েছে, তা কেউ জানে না। তা সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত আমরা যা জানি তা হলো- স্থাপনাটি গুরুতর ও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,’ মঙ্গলবার সিবিএস নিউজে সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে আরাগচিকে এমনটাই বলতে শোনা গেছে।