সুইস আল্পস অঞ্চলে একের পর এক ঘটনা পরিক্রমায় সুইজারল্যান্ডের বার্চ হিমবাহ নাটকীয়ভাবে ধসে পড়ে। এতে নিচের উপত্যকায় অবস্থিত ব্লাটেন গ্রাম সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
শুক্রবার (৩০ মে) ফরাসি গণমাধ্যম এএফপিকে এ তথ্য জানিয়েছেন হিমবিজ্ঞানী ও ভূবিজ্ঞানীরা।
জেনেভা থেকে এএফপি জানায়, বিশেষজ্ঞরা কয়েকদিন আগেই ধারণা করেছিলেন, বুধবার যে ভূমিধস হয়েছে, তা হিমবাহটির ভয়াবহ ধসের কারণ হতে পারে। কিন্তু এর মূল কারণগুলো আরও অনেক আগে থেকেই তৈরি হতে শুরু করেছিল।
এ ঘটনার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে জোরালো কিছু তত্ত্ব রয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কতটুকু, সে নিয়েও আলোচনা চলছে-তবে এখনো সেসব নিশ্চিতভাবে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়নি।
লুজান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব আর্থ সারফেস ডায়নামিক্স’-এর সিনিয়র প্রভাষক ক্রিস্টোফ লামবিয়েল বলেছেন, ‘এটিকে একটি ধারাবাহিক বা চেইন রিঅ্যাকশন ধরনের ঘটনা হিসেবে ধরা যায়, কারণ এখানে একাধিক প্রক্রিয়া যুক্ত হয়েছে।’
হিমবাহের ওপরে থাকা পর্বত
হিমবাহটির ওপরে অবস্থিত ৩,৩৪২ মিটার (১০,৯৬৫ ফুট) উচ্চতার ক্লেইনেস নেস্টহর্ন পর্বত আগে থেকেই কিছুটা অস্থিতিশীল ছিল, আর ভূমিক্ষয়ের গতি বিশেষভাবে ধসে পড়ার ১০ দিন আগে থেকেই দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ছিল, যেকোনো সময় পুরো পর্বত ধসে পড়তে পারে। তবে একসঙ্গে ধস না হয়ে কয়েকদিন ধরে ছোট ছোট ধস হতে থাকাটা আপাতত ‘সবচেয়ে সহনীয়’ পরিণতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
হিমবাহের ওপর পাথরধস
প্রায় ৩০ লাখ ঘনমিটার পাথর হিমবাহের ওপর এসে পড়ে।
গ্লেসিয়ার মনিটরিং সুইজারল্যান্ডের পরিচালক ম্যাথিয়াস হুস বলেন, ‘আপনি যদি একটি অস্থিতিশীল ভিত্তির ওপর অনেক ওজন চাপিয়ে দেন, সেটি পিছলে যেতে পারে। ঠিক সেটাই ঘটেছে। এই অতিরিক্ত ওজনের প্রতিক্রিয়ায় হিমবাহটি দ্রুত সরে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দুর্যোগ ঘটে যায়।’
বার্চ হিমবাহ
বার্চ হিমবাহটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, সুইজারল্যান্ডের একমাত্র হিমবাহ, যা পিছু হটার পরিবর্তে অগ্রসর হচ্ছিল। তবে এর পেছনে অতিরিক্ত তুষারপাত দায়ী নয়।
হুসের মতে, ‘এটি সম্ভবত ওই পর্বত থেকে ক্রমাগত পাথরধসের কারণে প্রাক-লোডিং অবস্থায় ছিল, যার ফলে হিমবাহটি সামনের দিকে ঠেলতে শুরু করে। কাজেই ভূমিধস হঠাৎ করে হয়নি।’
হিমবাহটি এমনিতেই একটি ঢালু এলাকায় ছিল, আর সামনের দিকটি ছিল আরও ঢালু, যা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তোলে।
মঙ্গলবার হিমবাহের সামনের দিক থেকে ছোট আকারের খণ্ড খণ্ড ধস হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, বুধবারের আকস্মিক পুরো ধসটি ছিল অপেক্ষাকৃত অপ্রত্যাশিত।
হিমবাহ যেভাবে ধসে পড়ল
লামবিয়েল জানান, ভূমিধসের ফলে হিমবাহের ওজন এবং তার ঢালের মধ্যকার চাপের ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে, যা এর সামনে এগিয়ে যাওয়ার গতি নির্ধারণ করে।
তিনি বলেন, ‘যেমন আপনি কোনো গাড়ি ঠেলে চালু করতে চাইলে প্রথম ধাক্কায় বেশি জোর লাগে, কিন্তু একবার চলতে শুরু করলে তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যায়।’
হুস বলেন, ‘হিমবাহটি লটশেনটাল উপত্যকার নিচের মাটি থেকে ১,০০০ মিটার উচ্চতায় ছিল, ফলে এতে বিপুল পরিমাণ সম্ভাব্য শক্তি জমা ছিল। আর এই ঘর্ষণজনিত শক্তি বরফের একাংশ গলিয়ে ফেলে, ফলে পতনটি শুধুই পাথরের পতনের চেয়ে অনেক বেশি গতিশীল হয়ে ওঠে।’
গলতে থাকা পারমাফ্রস্টের ভূমিকা
আল্পস জুড়ে পারমাফ্রস্ট পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। পাহাড়ের পাথরের ফাটলের মধ্যে জমে থাকা বরফ গলতে গলতে আরও গভীরে প্রবেশ করছে, বিশেষ করে ২০২২ সালের গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহের পর থেকে।
লামবিয়েল বলেন, ‘পাহাড়ের ভেতর বরফকে আমরা সিমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করি। যখন এই সিমেন্টের গুণমান কমে যায়, তখন পর্বতের স্থিতিশীলতাও হ্রাস পায়।’
হুস যোগ করেন, ‘এই পর্বত ধসে পড়েছে শুধু পারমাফ্রস্ট গলার কারণে-এমনটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, এটিকে একটি সম্ভাব্য কারণ কিংবা ত্বরান্বিতকারী উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যায়।’
জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা
অস্ট্রিয়ার গ্রাৎস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানী জ্যাকব স্টেইনার বলেন, ‘এই বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব আছে কি না-এমন কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনো নেই।’
হুস বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনই যদি একমাত্র কারণ হত, তাহলে আল্পসের সব পাহাড়ই তো ধসে পড়ত-কিন্তু তা হচ্ছে না। এটি পাহাড়ের দীর্ঘমেয়াদি ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের একটি সমন্বিত ফলাফল। হিমবাহের ধসকে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। বরং এটি পারমাফ্রস্ট-সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি জটিল প্রক্রিয়ার ফল।’
হিমবাহের গতিশীলতা ও এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে লামবিয়েল বলেন, ‘খোলামেলাভাবে বললে, আমরা নিশ্চিত নই।’
‘তবে গত ১০ বছরে হিমবাহের ওপর পাথরধস বেড়েছে-এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে।’
সূত্র : বিবিসি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত