প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন, রাষ্ট্রের অর্থ সাশ্রয়, আন্তঃপ্রকল্প সমন্বয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অত্যন্ত যৌক্তিক কারিগরি সক্ষমতা তৈরি করতে গিয়ে টেলিকম মাফিয়াদের রোষানলে পড়েছি। আমি দস্যু চক্রের কবলে। তিনি বলেন, মাফিয়া সিন্ডিকেটগুলোর মূল চরিত্র এটাই যে আপনি সৎ থাকবেন, মাফিয়া স্বার্থে আঘাত হানবেন, তখন সব হায়েনা আপনাকে ঘিরে ধরবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘আমি পিছু হটব না। আমাকে ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেওয়া যাবে না। যেহেতু কোনো দুর্নীতি-অনিয়ম করিনি, পদ্ধতিগত কোনো ভায়োলেশন করিনি এবং রাষ্ট্রের কোনো অর্থ চুরি করিনি তাই ভয় আমি পাই না।’
তিনি বলেন, ‘আমি ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে ফাইট করা লোক। টেলিকম ও আইসিটি সেক্টরের মাফিয়া সিন্ডিকেটের কবর দেব। লড়াই চলবে। হাই মোরাল নিয়েই লড়ব।’
সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি ফাইভ-জির উপযোগীকরণে বিটিসিএলের ‘অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে ক্রয়প্রক্রিয়া নিয়ে ওঠা অভিযোগেরও ব্যাখ্যা দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘বিটিসিএল ফাইবার নেটওয়ার্ক বর্ধিতকরণের যে প্রকল্প বিগত সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছে, যার টেন্ডার বিগত সরকারের আমলে হয়েছে, যেখানে টেন্ডার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার যে ঘটনাগুলো বিগত সরকারের আমলে হয়েছে এবং সেখানে যে একটা এলসি করা হয়েছিল, আমি এবং নাহিদ ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার আগে এই এলসিতে ২৯০ কোটি টাকা পরিশোধও করা হয়ে গেছে। এসব কিছু আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি নিজে ওনার অফিসে গিয়েছি। আমি বলেছি যে স্যার যেহেতু ২৯০ কোটি টাকা চলে গেছে, যেহেতু এটা (হুয়াওয়ে) সর্বনিম্ন দরদাতা, এবং ক্যাপাসিটি নিয়ে যেই অপতথ্যটা এসেছিল, সেটা বুয়েট যেহেতু পরিষ্কার করেছে, আমরা একটা কমিটি করে দেব, যেই কমিটির মাধ্যমে যে ইকুইপমেন্টগুলো তারা নিশ্চিত করবে, সেটা আসবে।’
তিনি বলেন, ‘এটাকে অপব্যাখ্যা করে আমাদের, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে, আমার মিনিস্ট্রিকে এবং আমাদের সরকারকে চরিত্রহরণের একটা চেষ্টা করা হয়েছে। আমি এবং আমার মন্ত্রণালয়ের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনো ধরনের কোনো দুর্নীতিতে জড়িত নই। এখানে যত ধরনের কাজ হয়েছে প্রত্যেকটা কাজ আগের সরকারের আমলে হয়েছে। আমরা শুধু কিছু চিঠি আদান-প্রদান করে আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি এবং দুদক চেয়ারম্যানের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছি। এর বাইরে কোনো নির্দেশ দিইনি।’
প্রধান উপদেষ্টার এই বিশেষ সহকারী আরও বলেন, ওই প্রকল্পের বিপরীতে দুদকের পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনো ধরনের মামলা নেই। সুতরাং যে বিষয়টি করা হচ্ছে তারা বলছেন যদি এই কাজটি না করা হয় এবং এলসি না খোলা হয়, তাহলে দুটি ঘটনা ঘটবে। ৩০০ ও ৩০০ মিলিয়ে মোট ৬০০ কোটি টাকা গচ্চা যাবে। একই সঙ্গে বিটিসিএল দুর্বল হয়ে এই বাজার থেকে বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর টেলিকম সেক্টরে বেশ কিছু সংস্কার কাজ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার এই বিশেষ সহকারী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টেলিকম খাতকে দুর্নীতি ও ফ্যাসিস্টের দোসর মুক্ত করে ভবিষ্যৎ উপযোগী করতে বিটিআরসি লাইসেন্সিং ফ্রেমওয়ার্ক সংস্কার শুরু করে। আওয়ামী সরকার পরিবর্তনের সাত মাস পর চাপের মুখে বিটিআরসি আইওএফ কার্টেল ভেঙে দেয়। পৃথিবীর কোথাও এই মডেল চালু নেই। এর আগে ১২ বছরে এই সংগঠনের কারণে সরকার ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিটিআরসি এবং ডাক টেলিযোগাযোগ বিভাগ বর্তমানে একটি নতুন প্রজন্মের টেলিকম লাইসেন্স পলিসি নিয়ে কাজ করছে। এরপর থেকেই কতিপয় মিডিয়া এবং স্বার্থান্বেষী কমিউনিকেশন মাফিয়াদের রোষানলে পড়েছি।’
ফাইবার অবকাঠামোতে একচেটিয়া অধিকার বা মনোপলি বন্ধ হবে কি না, জানতে চাইলে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘২০১০ সালে মোবাইল অপারেটরদের অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবর্তে ফাইবার লাইসেন্স একচেটিয়া ও পক্ষপাতমূলকভাবে দুইটি কোম্পানিকে দেওয়া হয়, যা দেশের মূল ইন্টারনেট অবকাঠামোতে একটি দ্বৈত একচেটিয়া মনোপলি বাজারব্যবস্থা সৃষ্টি করে। নতুন পলিসি অনুমোদন হলে মনোপলি মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে। প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার ‘ইনফো সরকার-থ্রি’ প্রকল্পের অধীনে জাতীয় ফাইবার রোলআউট মূলত তারা আওয়ামী লীগের সাহায্যে কুক্ষিগত করে, যার বেশির ভাগ অবকাঠামো কার্যত দুইজনের দ্বারা বেসরকারীকরণ করা হয। প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে যাদের ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করার কথা, সেখানে ব্যাপক অনিয়ম ও প্রভাব বিস্তার করে একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করা হয়েছে।
বর্তমান সংস্কার কি জনস্বার্থে করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জানান, এটা আশ্চর্যের যে বর্তমানের অনেকেই প্রস্তাবিত সংস্কারের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যবসায়িক সুবিধাভোগীদের সঙ্গে অজান্তেই একমত পোষণ করছে। এরা গত পনেরো বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে এবং নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারে ডিজিটাল ইকোনমি হতে বাধার সৃষ্টি করছে। বর্তমান অবস্থান থেকে মনে হয়, তারা ভুল তথ্য বা প্ররোচনার শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, সাশ্রয়ী মূল্যের মোবাইল ইন্টারনেট ও প্রতিযোগিতামূলক ডিজিটাল ইকোসিস্টেম নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও শোষণমূলক লাইসেন্সিং স্তর যেমন আইসিএক্স, আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইওএফ বিলুপ্ত করতে হবে। এই সত্তাগুলো অপ্রয়োজনীয় খরচের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যা শেষ পর্যন্ত মোবাইল গ্রাহক ও নাগরিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশকে টেলিকম কানেকটিভিটি থেকে ডিজিটাল সার্ভিসভিত্তিক ট্রান্সফরমেশনে নিতে হবে। ইন্টারনেট সস্তা করা, জাতীয় ফাইবার উন্মুক্ত করা প্রয়োজন। সত্যিকার সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সাহস, নিয়ন্ত্রণকারী স্বচ্ছতা ও জাতীয় স্বার্থে প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। আওয়ামী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জিম্মি দশা থেকে টেলিযোগাযোগ খাতকে অবমুক্ত করা জরুরি। সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আইসিটিতে যে কাজগুলো করছি আপনারা জানেন, সেখানে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার অন্যায্য প্রকল্প বাদ দিয়েছি। নতুন বাজেটে আইসিটি থেকে কোনো নতুন প্রকল্প তুলি নাই। কারণ একনেক মিটিংয়ে আমি স্যারকে (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছি যে স্যার, যেহেতু এখানে অনেক দুর্নীতি হয়েছে, ২০টার মতো প্রজেক্ট আইসিটিতে আছে। ছয়টার মতো প্রজেক্ট পোস্ট এবং টেলিকমে আছে। আমি চাই এই প্রকল্পগুলোকে অপ্টিমাইজ করতে। অর্থাৎ এখানে একটা শৃঙ্খলা দিয়ে আসতে। এটা যখন শেষ হবে তখন আমরা নতুন প্রজেক্ট তুলব।’