জুলাই গণ অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতির টেকসই পুনরুদ্ধারসহ নানা প্রত্যাশা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ওই সরকারের আমলে রাজনীতিবিদ ও সরকারঘনিষ্ঠরা ব্যাপক অর্থ পাচার, আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ ও নানা ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন বলে তারা অভিযোগ করেন।
তবে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা উন্নতি এবং রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির মতো কিছু ইতিবাচক অর্জন হয়েছে।
কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যাঘাত, ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বলতা এসব বড় চ্যালেঞ্জ এক বছর ধরে ব্যবসা ও বাণিজ্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বড় প্রত্যাশা নিয়ে ছিলাম। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই, তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক সুদের উচ্চহার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজস্ব বোর্ডে অস্থিরতা এবং বন্দরসংক্রান্ত সমস্যাগুলো রয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা এবং গণপিটুনির মতো ঘটনাগুলো দেশে ব্যবসায়িক আস্থা নষ্ট করেছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে গত এক বছরে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে বেকারত্ব বেড়েছে।
শিল্প পুলিশ জানায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি শিল্প ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এতে প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ব্যাংক খাত ও রিজার্ভে স্থিতিশীলতা কিছুটা অর্জন হলেও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট রয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, যদিও কিছুটা উন্নতি শুরু হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। নীতিনির্ধারণী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি মুদ্রানীতি ও উচ্চ সুদের কারণে বেসরকারি খাত প্রত্যাশিতভাবে বিকশিত হতে পারেনি।’ তিনি আরও জানান, ব্যবসার উচ্চ ব্যয় ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে যন্ত্রপাতি আমদানি ও এলসি খোলার হারও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৯ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ০ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি। এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘গণ অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা ছিল সরকার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে, বাণিজ্য সংস্কার বাস্তবায়ন করতে এবং দুর্নীতি দমন করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কিছু অগ্রগতি হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’ অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জ্বালানি খাতের উন্নয়ন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।