বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই উত্তরণের ফলে দেশের রপ্তানিকারকরা উন্নত দেশগুলোর বাজারে আর আগের মতো শুল্কমুক্ত বা রেয়াতি সুবিধা পাবেন না। ফলে এখন থেকেই সেই সম্ভাব্য ধাক্কা সামাল দিতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ) নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলডিসি-পরবর্তী বিশ্ববাণিজ্য বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে আরও অনেক দেশের সঙ্গে দ্রুত ও কার্যকর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। একই সঙ্গে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দিতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা চলমান রয়েছে এবং আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই এ আলোচনা শেষ হতে পারে। এটি চূড়ান্ত হলে তা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, যা ডিসেম্বরের মধ্যেই সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম দফার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আলোচনা গত মার্চ মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। চলতি মাসেই দ্বিতীয় দফার আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। দুই দেশই ২০২৬ সালের মধ্যে এই চুক্তি সম্পন্ন করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চলতি জুলাই মাসেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে। আমিরাতের মন্ত্রিসভা ইতোমধ্যেই এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। আগামী মাসে মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরু করবে বাংলাদেশ। বহু বছর ধরে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনার পর অবশেষে তারা রাজি হয়েছে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক কর্মী পাঠায় এবং দেশটি থেকে ভোজ্যতেলসহ নানা পণ্য আমদানি করে। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টে (আরসেপ) যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তখন ভারতের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশকে তা থেকে বিরত থাকতে হয় বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ আবারও রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা আরসেপ-এ অংশগ্রহণের আবেদন করে এবং এবার সদস্যপদ গৃহীত হয়েছে। এখন চুক্তির আনুষ্ঠানিক আলোচনা শিগগিরই শুরু হবে।
২০২৬ সালের শেষ নাগাদ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের ফলে বাংলাদেশ ইউরোপ, কানাডা, জাপানসহ নানা উন্নত বাজারে বিদ্যমান শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে। এর ফলে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হ্রাস পাবে। এই বাস্তবতায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেই নতুন বাজার ও আগের সুবিধা ধরে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের সময়সীমা ২০২৬ সালই যথার্থ ও প্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘এখন মূল বিষয় হচ্ছে- উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে একটি উত্তরণকালীন কৌশল নির্ধারিত রয়েছে। তবে শুধু পরিকল্পনা নয়, তার বাস্তবায়নে প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং আর্থিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, এলডিসি উত্তরণ শুধু অর্থনৈতিক অর্জন নয়, এটি একটি জাতীয় রূপান্তরের প্রক্রিয়া।
তাই বিষয়টি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে গুরুত্বসহকারে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে নতুন সরকার তার মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। এতে উত্তরণ প্রক্রিয়া হবে আরও সংগঠিত, অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই।”