যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যে আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা। তবে সতর্ক করে তারা বলেছেন, এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে শুল্ক হার যথাক্রমে ২০, ১৯ এবং ১৯ শতাংশ। নতুন এ শুল্কহার বাংলাদেশকে কিছুটা সমান ভিত্তিতে নিয়ে এলেও মোট কার্যকর শুল্ক অন্যান্য চার্জসহ এখনো প্রায় ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি, যা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।
এ বিষয়ে স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘আমরা স্বস্তি পেয়েছি। কিন্তু ২০ শতাংশ এখনো একটা বড় বোঝা। যখন সব খরচ বিবেচনায় নিই, কার্যকর শুল্ক এখনো বেশ ভারী। তিনি অভ্যন্তরীণ সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, জ্বালানি সরবরাহ, বন্দর পরিচালনা, দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা আমাদের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা হ্রাস করছে। এসব সমস্যা সমাধানে বেসরকারীকরণ ও রপ্তানিবান্ধব নীতির প্রয়োজন।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘এ অর্জন গত কয়েক মাসের আলোচনার ফল। এখন সরকারের দায়িত্ব আলোচনার সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি বিশেষ করে কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়া সহজীকরণ বাস্তবায়ন করা।’ অনন্ত অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির বলেন, ‘চীনের রপ্তানিতে এখন ৩৪ শতাংশের বেশি শুল্ক। ফলে ক্রেতারা নতুন বিকল্প খুঁজছে। বাংলাদেশে উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা সেই সুযোগ নিতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা, গম, এলএনজি বা বিমান কেনাও একটি বৃহৎ বাণিজ্য সমীকরণের অংশ।’ তিনি জানান, মার্কিন তুলা ব্যবহার করলে কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যাবে। যদি কোনো ক্রেতা ২০ শতাংশ মার্কিন তুলা ব্যবহার করে, তাহলে সে কর অব্যাহতির আওতায় পড়বে এটা আমাদের জন্য নতুন একটি প্রণোদনা। ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ফজলে শামীম এহসান বলেন, ১৯-২০ শতাংশ শুল্ক আমাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখবে। তবে স্বল্পমেয়াদে কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে মূল্য বৃদ্ধি হতে পারে, ক্রেতারা দাম কমাতে চাপ দিতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের এখনো অনেক কাঁচামাল চীন ও ভারত থেকে আসে। বিশেষ করে স্নিকার ও স্পোর্টসওয়্যারের ক্ষেত্রে স্থানীয় মূল্যসংযোজন খুবই কম। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে সহজ রপ্তানি ঋণ ও শিল্প প্রণোদনা দাবি করেন। বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, আমাদের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন আলোচনায় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ৭৫ শতাংশে কমানোর প্রস্তাব দেন এটা এক অভূতপূর্ব কূটনৈতিক দৃষ্টান্ত। ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এই সিদ্ধান্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সুবিধা টিকিয়ে রাখতে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
বিজিএমইএ পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তখন বিশ্ববাজারে আমাদের প্রস্তুতি ধীর ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা ফল পেয়েছি। তিনি ক্রেতাদের সঙ্গে মূল্য পুনঃ আলোচনা, উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের ওপর জোর দেন।’ তিনি একটি জাতীয় জোট গঠনের প্রস্তাব দেন, যেখানে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, সিভিল সোসাইটি, শ্রমিক প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী সংগঠন একসঙ্গে কাজ করবে। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এই ২০ শতাংশ শুল্ককে ‘উইন-উইন’ সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় আমরা এখন কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে কোনো সময় আবার সিদ্ধান্ত বদল করতে পারেন আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘চীনের রপ্তানি কমছে এটা আমাদের জন্য সুযোগ। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও দুর্বল আর্থিক কাঠামো আমাদের পেছনে ফেলতে পারে।’ হাতেম বলেন, গত দুই বছরের ভুল আর্থিক নীতিই শিল্পে মন্দা এনেছে। এখন সময় দ্রুত ও কার্যকর নীতি সংস্কারের। সার্বিকভাবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পণ্যে শুল্ক হ্রাসে বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনায় নতুন দিগন্ত খুলেছে। তবে দেশীয় কাঠামোগত দুর্বলতা, জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং নীতি অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে এই সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সময় এসেছে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত বাণিজ্য কৌশল গঠনের।