বেসরকারি খাত থেকে জাতীয়করণ। পরবর্তীতে আবারও বেসরকারি খাতের মালিকানায় ফিরে নতুন যাত্রা শুরু করে পূবালী ব্যাংক। সমস্যায় পড়া ব্যাংক থেকে উঠে এসে এখন এটি আধুনিক ও শক্তিশালী একটি ব্যাংক। মুনাফা ও কর্মী সুবিধায় এখন দেশের শীর্ষ ব্যাংক। পূবালী ব্যাংকের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং ব্যাংক খাতের সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - শাহেদ আলী ইরশাদ
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ঋণ শ্রেণিকরণে আন্তর্জাতিক মানের নীতিমালা চালু হচ্ছে মার্চে, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ আলী : ঋণ শ্রেণিকরণব্যবস্থা একটি ব্যাংকের স্বচ্ছতা, স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম মানদণ্ড। যখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আমাদের ব্যাংক পরিদর্শন করে, তখন তাদের প্রথম প্রশ্ন থাকে-মূলধন পর্যাপ্ততা কতটুকু, খেলাপি ঋণের হার কেমন, মন্দ সম্পদের পরিমাণ কত- প্রভৃতি। ঋণখেলাপির বিষয়টি মূলধন পর্যাপ্ততার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত- ঋণ শ্রেণিকরণে আন্তর্জাতিক মানের নীতিমালা চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগ নিয়েছে তা যথাযথ ও সময়োপযোগী।
আমার মতে, খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ হওয়া উচিত। জনগণ ও গ্রাহকদের জানা দরকার কোন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত, যাতে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে শুধু আমানতকারীরাই নন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আমাদের ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ওপর স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আরও সুসংহত হবে।
যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছে, এটি ব্যাংকগুলোর জন্য দরকষাকষিতে সুবিধাজনক হতে পারে। আমানতকারীদের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা যদি কোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত না থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। যদি তারা জানেন কোন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন কোথায় আমানত রাখা নিরাপদ। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ তথ্য থাকলে ভবিষ্যতে আমানতকারীরা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে রক্ষা পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ আমাদের ব্যাংকিং খাতকে আরও মজবুত ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক করতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা, সেখানে পূবালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ শতাংশের কম রেখেছেন কীভাবে?
মোহাম্মদ আলী : এটি সম্ভব হয়েছে সুশাসন, কঠোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং স্বাধীন ঋণ মূল্যায়ন ব্যবস্থার ফলে। আমাদের পরিচালনা পর্ষদ সব সময় সুশাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন আর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও উদ্যোগ নিয়েছেন তা বাস্তবায়নের। ফলে আমাদের কর্মকর্তারা যার যার দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করতে পারেন, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।
আমাদের ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়াটি সুপরিকল্পিত ও বহুমাত্রিক। বড় ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রেও মূল প্রস্তাব অবশ্যই শাখা থেকে আসতে হবে। শাখা পর্যায়ে স্বাধীন মূল্যায়নের পর আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ঋণ বিভাগ সেটি পুনর্মূল্যায়ন করে, এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়। এভাবে প্রতিটি স্তরে যথাযথ যাচাইবাছাই নিশ্চিত করা হয়। ফলে কোনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা ব্রিফকেস কোম্পানির অনৈতিক ঋণ গ্রহণের সুযোগ থাকে না। এমনকি যারা ঋণের জন্য সরাসরি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে, আবেদন শাখার মাধ্যমেই করতে হবে।
বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে, পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে এটি ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও আমাদের খেলাপি ঋণের হার ২.৬৭ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায়ও কম। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক তদারকি, সুশাসন এবং স্বাধীনভাবে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : পূবালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ উঠেছে, প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
মোহাম্মদ আলী : আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক এবং বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই। পূবালী ব্যাংক বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ও এএএ রেটিংপ্রাপ্ত একটি ব্যাংক, যা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ অস্তিত্বহীন এক ব্যক্তির মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের করে এবং সেটি গণমাধ্যমে প্রচার করে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমরা যদি কোনো আমানতকারীকে উচ্চ সুদহার দিই, তবে উপকারভোগী হবেন আমানতকারী, যদিও এতে ব্যাংকের খরচ বেড়ে যায়। আবার ঋণের সুদহার কমালে গ্রাহক সুবিধা পান, কিন্তু ব্যাংকের আয় হ্রাস পায়। এসব সিদ্ধান্ত আমাদের ট্রেজারি বিভাগ সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করে। আমাদের আমদানি ব্যয় ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকা, আর রপ্তানি আয় ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে বাকি ১১-১২ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স থেকে আনতে হয়েছে, যাতে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা সম্ভব হয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ডলারের অতিরিক্ত দর আত্মসাৎ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমদানির সময় ডলারের বাজার দর অস্থিতিশীল থাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই ছিল। অতিরিক্ত ব্যয় এক জিনিস, আর আত্মসাৎ আরেক জিনিস। পূবালী ব্যাংক কখনোই কোনো অনিয়মে লিপ্ত হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা শাস্তিমূলক চিঠি দেয়নি। এই ভিত্তিহীন অভিযোগ আমাদের স্বাভাবিকভাবেই আহত করেছে। যে কোনো ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন, কিন্তু অভিযোগ বিষয়ে তার স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও সত্যতা, সামাজিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব প্রভৃতি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে বিবেচনা করা হয়নি, যা দায়িত্বশীলতার অভাব প্রকাশ করে। এমন উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার শুধু আমাদের ব্যাংকের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ন করে না বরং দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ঋণ শ্রেণিকরণের আন্তর্জাতিক নিয়মে ব্যাংক খাতের কী কী লাভ হবে?
মোহাম্মদ আলী : প্রকৃত চিত্র প্রকাশ হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা আসবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানতে পারবে কোন ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা কেমন। এতে ঋণ আদায়ের উদ্যোগ জোরদার হবে, অর্থঋণ আদালতে কার্যক্রম বেগবান হবে এবং খেলাপিদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানের নিয়ম অনুসরণের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে, যা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধিতে কার্যকর প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বৃদ্ধি কতটা কার্যকর হয়েছে?
মোহাম্মদ আলী : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বৃদ্ধি একটি কার্যকর কৌশল, কারণ এটি বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমায় এবং বিনিয়োগের গতি কিছুটা ধীর করে। ফলে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য আসে। আমরা ইতোমধ্যে দেখছি, কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় কিছু পণ্যের ওপর এখনো চাপ রয়েছে। নীতি সুদহার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে। সুদহার বাড়ানোর ফলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন, ফলে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমেছে। তবে শুধু নীতি সুদহার বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতিগুলোরও কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে রাজস্ব আয় বাড়ানো, কালো টাকার প্রবাহ কমানো এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থিতিশীল রাখাও জরুরি। নীতি সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে অর্থনীতিতে আরও স্থিতিশীলতা আসবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রমজানের পণ্য আমদানিতে পূবালী ব্যাংকের ভূমিকা কেমন?
মোহাম্মদ আলী : আমরা রমজানের আগে বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যাপকভাবে ঋণপত্র (এলসি) খুলেছি। এ বছর জানুয়ারি মাসে পূবালী ব্যাংকের আমদানির প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬০% হয়েছে। আমরা তেল, চিনি এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির বড় অংশীদার। সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য আমরা রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। ফলে রমজানে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : পূবালী ব্যাংক নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মোহাম্মদ আলী : এখন প্রযুক্তির যুগ-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও) ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের যুগ। আমাদের লক্ষ্য হলো পূবালী ব্যাংককে সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা। আমরা ইতোমধ্যে চঁনধষর চর নামে ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ চালু করেছি, যা করপোরেট এবং এসএমই গ্রাহকদের সেবা দেবে। আমাদের পরিকল্পনা হলো - গ্রাহক যেন তার ব্যাংকিং কার্যক্রম মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে পারেন। ঋণ, এলসি, রিটেইল ব্যাংকিং- সবকিছুই যেন অনলাইনে করা যায়। প্রয়োজনে গ্রাহক শুধু কল সেন্টারে কল করেই সেবা নিতে পারবেন। আমরা আশা করছি, ২০২৬ সালের মধ্যে পূবালী ব্যাংককে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল ব্যাংকে রূপান্তর করতে পারব। আমাদের এ রূপান্তর ব্যাংকের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে এবং গ্রাহকদের জন্য ব্যাংকিং সেবা আরও সহজ করে তুলবে।