বর্তমানে সারা দেশে শিশুদের টাইফয়েড রোগ প্রতিরোধের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টিকাদান ক্যাম্পেইন চলছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (EPI) আওতায় ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি প্রায় ৫ কোটি শিশুকে এই জীবনদায়ী টিকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, কিছু মহল এই টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে ভিত্তিহীন ও ক্ষতিকর গুজব ছড়াচ্ছে। একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এই টিকা অত্যন্ত নিরাপদ এবং শিশুদের জন্য এর উপকারিতা অনস্বীকার্য।
কেন টাইফয়েড টিকা জরুরি
টাইফয়েড জ্বর একটি গুরুতর রোগ, যা Salmonella Typhi নামক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে এই রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির সমস্যা অনেকটাই প্রকট, সেখানে টাইফয়েড শিশুদের জন্য এক নীরব ঘাতক।
টাইফয়েড কেন শিশুদের জন্য প্রাণঘাতী
১. তীব্র অসুস্থতা : টাইফয়েড হলে শিশুর উচ্চ জ্বর, পেটে ব্যথা, বমি, দুর্বলতা এবং কখনো কখনো ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। এই জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
২. মারাত্মক জটিলতা : সময়মতো চিকিৎসা না হলে বা রোগ গুরুতর হলে অন্ত্রে রক্তক্ষরণ, অন্ত্রে ফুটো (perforation) এবং মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের সংক্রমণ (meningitis বা encephalopath) হতে পারে, যা শিশুর জীবন কেড়ে নিতে পারে।
৩. অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (Antibiotic Resistance) টাইফয়েড : বর্তমানে মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (MDR) ও এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (XDR) টাইফয়েডের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকও অনেক সময় কাজ করে না। তাই এই অবস্থায় টিকা দেওয়া ছাড়া প্রতিরোধের আর কোনো বিকল্প থাকে না।
যে টিকাটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা কতটা নিরাপদ?
বর্তমানে EPI কর্মসূচিতে যে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV) ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বহুবিধ মানদণ্ডে পরীক্ষিত এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ।
১. WHO কোয়ালিফায়েড : টিকাটি জিএসকে (GSK) ফর্মুলায় প্রস্তুতকৃত এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক গুণগত মান ও কার্যকারিতার ভিত্তিতে অনুমোদিত।
২. বহুল ব্যবহৃত ও প্রমাণিত : বিশ্বব্যাপী এই ধরনের টিকা বহু বছর ধরে শিশুকে দেওয়া হচ্ছে এবং এর নিরাপত্তা প্রোফাইল চমৎকার।
৩. ICDDR,B গবেষণা : আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (ICDDR,B)-এর মতো বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই টিকার নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করেছে এবং তাদের ফলাফলে এটি শিশুদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। এই গবেষণালব্ধ ফলাফল আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এর নির্ভরযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
৪. সুবিধাজনক টিকা : টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV) অন্যান্য পুরোনো টাইফয়েড টিকার চেয়ে বেশি কার্যকর এবং এটি ৯ মাস বয়স থেকেই দেওয়া যায়। এটি মাত্র এক ডোজেই দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
গুজবে কান নয়, বিজ্ঞান ও বিশ্বাসে আস্থা রাখুন
গুজবে বলা হচ্ছে যে এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মারাত্মক বা এটি অন্য কোনো ক্ষতি করবে এই ধরনের প্রচার সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। অন্য যে কোনো টিকার মতো এই টিকারও কিছু সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যেমন : টিকা দেওয়ার স্থানে সামান্য ব্যথা, ফোলা বা জ্বর। এগুলো সাধারণত ১-২ দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায় এবং তা টাইফয়েড রোগের মারাত্মক জটিলতার তুলনায় কিছুই নয়। সরকার যখন কোটি কোটি শিশুর জীবন রক্ষায় এমন মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে তখন আমাদের উচিত এতে সমর্থন করা।
শিশুকে এই টিকা দিয়ে আপনি শুধু আপনার সন্তানকেই নয়, বরং সমাজকেও সুরক্ষিত করছেন। কারণ, টিকা নেওয়া শিশু রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি অনেক কমিয়ে দেয়। প্রতিকার নয়, প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।
-ডা. মিশু তালুকদার, শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ