মেরুদণ্ডের ব্যথা বা ব্যাক পেইন একটি অত্যন্ত সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা যেকোনো বয়সের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি শুধু কর্মক্ষমতা কমায় না, দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকেও ব্যাহত করে। পিঠের সামান্য অস্বস্তি থেকে শুরু করে তীব্র, অসহনীয় ব্যথা পর্যন্ত এর তীব্রতা হতে পারে। আধুনিক জীবনযাত্রায় শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা এবং ভুল জীবনযাপন পদ্ধতির কারণে এ সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মেরুদণ্ডের ব্যথা দিনদিন কম বয়সীদেরও বেড়ে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, “প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম” কিছু সহজ কিন্তু কার্যকরী কৌশল এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে মেরুদণ্ডের অধিকাংশ ব্যথাকেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সঠিক ভঙ্গিমা বজায় রাখা: মেরুদণ্ড একটি জটিল কাঠামো, যা শরীরের ভার বহন করে। ভুল ভঙ্গিমা এই কাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, ফলে ব্যথা হয়।
বসার সঠিক নিয়ম :
* পিঠ সোজা রাখুন: চেয়ারে বসার সময় পিঠের নিচের অংশকে (লোয়ার ব্যাক) সোজা রাখুন এবং পিঠের স্বাভাবিক বক্রতা বজায় রাখতে লাম্বার সাপোর্ট বা ছোট বালিশ ব্যবহার করুন।
* চেয়ারে বসা : নিচু জিনিস যেমন- পিঁড়া, বা ফ্লোরে না বসে চেয়ারে পিঠ সাপোর্ট দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসবেন।
* পা মাটিতে রাখুন : আপনার পা দুটি যেন মাটিতে সমতলভাবে থাকে। হাঁটু যেন নিতম্বের চেয়ে সামান্য উঁচুতে বা একই সমতলে থাকে। পা ক্রস করে বসা থেকে বিরত থাকুন।
* কম্পিউটার/মনিটরের অবস্থান : মনিটর চোখের সমতলে বা সামান্য নিচে রাখুন, যাতে ঘাড় বা মাথা বাঁকাতে না হয়। কীবোর্ড এমনভাবে রাখুন যেন কনুই ৯০ ডিগ্রি কোণে আরামদায়কভাবে বিশ্রাম নেয়।
* বিরতি নিন : দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকবেন না, ১ ঘণ্টা পরপর অবস্থান বদলাবেন। একটানা ৩০-৪০ মিনিটের বেশি বসে থাকবেন না। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর উঠে দাঁড়ান, হাঁটুন।
দাঁড়ানোর সঠিক নিয়ম :
* ভারসাম্য রক্ষা : মাথা উঁচু রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ান, কাঁধ শিথিল রাখুন এবং পেটের পেশি সামান্য ভিতরের দিকে টেনে রাখুন। শরীরের ভার দুই পায়ের ওপর সমানভাবে রাখুন।
* দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো : দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হলে একটি পা ৬ ইঞ্চি উঁচু কোনো টুল বা বাক্সের ওপর রাখুন এবং কিছুক্ষণ পরপর পা পরিবর্তন করুন। মেরুদণ্ডের নিচের অংশের চাপ কমবে।
ঘুমের সঠিক নিয়ম :
* বিছানা নির্বাচন : ফোম ও নরম ম্যাট্রেস বা তোশক/গদিতে না শুয়ে উঁচু শক্ত সমান বিছানায় শোবেন। ১-২ ইঞ্চি পুরুত্বের তোষক বা ম্যাট্রেস ব্যবহার করবেন। খুব নরম বা খুব শক্ত ম্যাট্রেস ব্যবহার করা উচিত নয়। মাঝারি মানের শক্ত (মিডিয়াম ফার্ম) ম্যাট্রেস মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বক্রতাকে সমর্থন করে। ফ্লোরে বা শক্ত বিছানায় শোয়া যাবে না।
শোয়ার অবস্থান : চিৎ হয়ে শুলে হাঁটুর নিচে একটি বালিশ দিন। কাত হয়ে শুলে হাঁটু সামান্য ভাঁজ করে দুই হাঁটুর মাঝে একটি বালিশ রাখুন। উপুড় হয়ে শোয়া একেবারেই এড়িয়ে চলুন।
* বালিশ ব্যবহার : শোবার সময় একটি পাতলা নরম বালিশ ব্যবহার করবেন। প্রয়োজনে সারভাইক্যাল পিলো ব্যবহার করতে পারেন।
সঠিক উত্তোলন কৌশল :
ভারী জিনিস তোলার সময় ভুল পদ্ধতির কারণে মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাত লাগতে পারে। কোনো কিছু তুলতে গেলে কোমর থেকে ঝুঁকে নয়, বরং হাঁটু ভাঁজ করে বসুন এবং জিনিসটিকে শরীরের যতটা সম্ভব কাছে রাখুন। জিনিস তোলার সময় মেরুদণ্ড সোজা রাখুন। কোনো জিনিস তুলে তা নিয়ে মোচড়ানো বা হঠাৎ ঘোরানো এড়িয়ে চলুন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি?
যদিও বেশির ভাগ মেরুদণ্ডের ব্যথা জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং ঘরোয়া যত্নের মাধ্যমে ভালো হয়ে যায়, তবে কিছু লক্ষণ দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যেমন-ব্যথা এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে বা ক্রমশ খারাপ হলে। তীব্র ব্যথা হলে। পায়ের দিকে ব্যথা ছড়িয়ে পড়লে, বিশেষ করে নিতম্ব বা পায়ের নিচের অংশে অসাড়তা বা দুর্বলতা অনুভূত হলে।
-মো. সফিউল্যাহ প্রধান, ফিজিওথেরাপি, ডিজএবিলিটিস ও রিহেবিলিটেশন স্পেশালিস্ট ডিপিআরসি, শ্যামলী, ঢাকা