ডায়াবেটিস মেলাইটাস শুধু একটি শারীরিক বিপাকজনিত রোগ নয়, এটি একজন মানুষের মানসিক ও আবেগীয় জীবনের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। দীর্ঘস্থায়ী রোগ হিসেবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই নানা ধরনের মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতার সম্মুখীন হন। গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ডিপ্রেশন (বিষণ্নতা) ও অ্যাংজাইটি (উদ্বেগ) সাধারণ জনগণের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি দেখা যায়।
বিষণ্নতা
ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতার মধ্যে একটি দ্বিমুখী সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসা, নিয়মিত ওষুধ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ইনসুলিন ইনজেকশন এবং জটিলতার ভয় অনেক রোগীর মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। রক্তে শর্করার ওঠানামা মস্তিষ্কের নিউরোকেমিক্যাল পরিবর্তন ঘটিয়ে মনমরা ভাব, উদ্যমহীনতা, ঘুমের সমস্যা ও আগ্রহহীনতা তৈরি করতে পারে। ফলস্বরূপ রোগীরা ওষুধ ও ডায়েট মেনে চলায় অনীহা দেখান, যার ফলে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ আরও খারাপ হয়। একে বলা হয় ডায়াবেটিক সাইকোসোম্যাটিক চক্র।
উদ্বেগ ও মানসিক চাপ
অনেক রোগী প্রতিদিনের গ্লুকোজ পরীক্ষা, ইনসুলিন প্রয়োগ, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যৎ জটিলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। “হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ভয়” বা কম শর্করা নিয়ে আতঙ্কও এক ধরনের চিন্তাজনিত মানসিক ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ কর্টিসলসহ স্ট্রেস হরমোন বৃদ্ধি করে, যা আবার ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও গ্লুকোজ অস্থিরতা বাড়ায়।
ডায়াবেটিস ডিসট্রেস
এটি বিষণ্নতা নয়, তবে ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে অতিরিক্ত মানসিক ক্লান্তি, হতাশা ও “বার্নআউট” অবস্থাকে বোঝায়। রোগীরা মনে করেন তাঁরা যতই চেষ্টা করেন, তবুও ফল ভালো হচ্ছে না। এ অবস্থায় চিকিৎসকের সহানুভূতি ও রোগী-শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জ্ঞানীয় পরিবর্তন ও ডিমেনশিয়া
দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ ও নিউরনের ক্ষতি ঘটিয়ে জ্ঞানীয় ক্ষমতা হ্রাস, মনোযোগ কমে যাওয়া, এমনকি ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) পর্যন্ত ঘটাতে পারে। বিশেষত বয়স্ক ডায়াবেটিকদের মধ্যে এ ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। এমনটাই বেশি পরিলক্ষিত হয়।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা
ডায়াবেটিসে মানসিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতি প্রয়োজন।
* নিয়মিত মনস্তাত্ত্বিক স্ক্রিনিং করা উচিত (যেমন PHQ-9 বা DDS স্কেল)।
* কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT) ও মাইন্ডফুলনেস ট্রেনিং কার্যকর প্রমাণিত।
* পরিবার ও সমাজের সহায়তা, রোগী সহায়তা গোষ্ঠী ও কাউন্সেলিং রোগীর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
* প্রয়োজনে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ ব্যবহারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
* সর্বোপরি, চিকিৎসকের সহানুভূতি ও নিয়মিত ফলো-আপ রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বড় ভূমিকা রাখে।
ডায়াবেটিস কেবল রক্তে শর্করার রোগ নয়; এটি শরীর ও মনের পারস্পরিক সম্পর্কের রোগ। মানসিক সুস্থতা ছাড়া গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ বা সামগ্রিক সুস্থতা সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি ডায়াবেটিস চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়নকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। তাই এসব বিষয়ে অবহেলা না করে আমাদের সবাইকে আরও বেশি যত্নবান হতে হবে।
-ডা. শাহজাদা সেলিম, সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়