হৃদরোগ দেশের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা। হৃদরোগ প্রতিরোধে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিন গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে হৃদরোগের সেবা উন্নত করা, স্বাস্থ্যবিমা চালু করা, সেবায় সমন্বয়হীনতা দূর করা, রেফারেল সিস্টেম চালু করা, খাদ্যাভ্যাস-জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা, চিকিৎসায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং রোগীর সুরক্ষায় যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনার চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন - জয়শ্রী ভাদুড়ী, আবদুর রহমান টুলু, আবির আবদুল্লাহ এবং ইমরান চৌধুরী - ছবি : রোহেত রাজীব
চিকিৎসায় সংকটের তুলনায় সমন্বয়হীনতা বেশি
মো. সাইদুর রহমান
সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়
দেশে হৃদরোগের চিকিৎসার পর্যাপ্ত ঘাটতি রয়েছে। সেসব ঘাটতি পর্যালোচনা করে আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কীভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায় সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে। হৃদরোগে আক্রান্ত হলে যাতে দ্রুত রোগ চিহ্নিত করা যায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। চিকিৎসাসেবায় সংকটের তুলনায় সমন্বয়ের অভাব বেশি। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি জায়গায় সমন্বয় তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার প্রতি দেশের মানুষের আস্থা কম। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিমার ক্ষেত্রে খুব একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানও নিজ উদ্যোগে বিমা কাঠামো গঠনের চেষ্টা করেছে; কিন্তু সফল হয়নি। এর জন্য মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। বিমার টাকা জমা দিলে সেটা যে ফেরত পাওয়া যাবে- মানুষের মাঝে এই আস্থা তৈরি করতে আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশে এখনো পোস্ট কেয়ার সার্ভিসের জন্য ঢাকায় আসতে হয়। এই জায়গাগুলোতে যথাযথ সমন্বয় করা গেলে রোগীদের ভোগান্তি অনেক কমে আসবে। সম্প্রতি ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সে একজন পল্লী চিকিৎসকের সাহায্যে নাটোরের এক রোগীর সফল সার্জারি করা হয়। গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। সেখানে মানসম্পন্ন সার্জন প্রয়োজন, কিন্তু তা পাওয়া যায় না। গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা পৌঁছে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার মান উন্নত করা প্রয়োজন। আর বিভাগীয় শহরগুলোতে যদি আমরা হৃদরোগের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে আর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হবে না। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন। চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নে অনেকে রেফারেল সিস্টেমের কথা বলে থাকেন। আমাদের দেশে এই সিস্টেম কার্যকর করা অনেক কঠিন। তবে এই সিস্টেমের প্রয়োজন আছে। রোগীদের যদি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা যায় তাহলে সবার কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো সম্ভব হবে।
বুকে ব্যথা হলে দ্রুত কার্ডিয়াক সেন্টারে যেতে হবে
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
এখনো বাংলাদেশের মানুষ বুকের ব্যথাকে অবহেলা করে। বুকে ব্যথা হলে একজন রোগীকে দ্রুত কার্ডিয়াক সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে। কারণ হার্টের চিকিৎসায় সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি ৯০ মিনিটের মধ্যে কোনো রোগী হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে তাহলে সেই মানুষটিকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় অর্ধ-শতাধিক কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছে ৩৫টির বেশি। বাংলাদেশ হৃদরোগ চিকিৎসায় এ মুহূর্তে গর্ববোধ করে। এখন দেশেই এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টিক, ওপেন হার্ট সার্জারি, ভাল্ব সার্জারি, প্রাইমারি পিসিআই, মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয়। একটি ভুল তথ্য প্রচলিত রয়েছে, বাংলাদেশের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের চিকিৎসা সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমা বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি। এটা করলে মানুষকে আর পকেটের টাকা খরচ করে চিকিৎসা করতে হবে না। পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য মানুষের বিদেশ যাওয়ার হার কমে যাবে।
বসুন্ধরায় এক ছাদের নিচে থাকবে সব স্বাস্থ্যসেবা
এস এম সাহিদুর রহমান
চেয়ারম্যান, এস রহমান গ্রুপ ও এস রহমান প্রোপার্টিজ
আমাদের স্বপ্ন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল সিটি গড়ে তোলা। একই কমপ্লেক্সে থাকবে শতাধিক চিকিৎসকের চেম্বার, আধুনিক ল্যাব, কনসালটেশন সেন্টার এবং হোলসেল মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মার্কেট। এতে বসুন্ধরার চিকিৎসকরা জনসেবায় অংশ নিতে পারবেন এবং সাধারণ মানুষ সহজেই স্বনামধন্য চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ ডাক্তার বসবাস করেন। তাদের প্র্যাকটিস এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার কথা চিন্তা করে একটি আধুনিক হাসপাতাল গড়ার উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমরা ছয় বিঘা জমি পেয়েছি। তিনি রাস্তা, ব্রিজ ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থাতেও সাহায্য করেছেন। এখানে ৯০ হাজার বর্গফুটের বৃহৎ পরিসরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার হবে, যা স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে অথবা পরবর্তীতে শেয়ার হিসেবে বিক্রি করা হবে।
হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য এখন বিদেশে যেতে হয় না
অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন আহমেদ
চিফ কার্ডিয়াক সার্জন, ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতাল
বাংলাদেশে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল ১৯৮১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। সেই বছর মোট ৩৩টি ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল। তখন অপারেশন সীমিত আকারে কেবল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হতো। তার আগে আমরা মূলত ‘ক্লোজড মাইট্রাল ভালভুলোটমি’ করতাম, যেটি অনেক কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আজকের বাংলাদেশ সেই জায়গায় নেই। এখন দেশে প্রায় ৩৫টিরও বেশি হার্ট সেন্টার রয়েছে, ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরে জেলাগুলোতেও। প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। ফলে এখন আর রোগীদের বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় না। প্রতিটি সেন্টারে প্রতিদিন একাধিক সার্জারি হচ্ছে। হৃদরোগের চিকিৎসায় দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বাইপাস সার্জারি। সমস্যা হচ্ছে, ভাল্ব রিপ্লেসমেন্ট যেসব ক্ষেত্রে দরকার হয়, সেটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সরকার যদি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে প্রাথমিক টেস্ট (ব্লাড টেস্ট, এক্স-রে, ইসিজি) সহজলভ্য করে, আর প্রাইভেট সেক্টরে কিছুটা ভর্তুকি দেয়, তাহলে রোগীরা উপকৃত হবে। এতে তাদের নিয়মিত ফলোআপ করা সহজ হবে। এ ছাড়া হৃদরোগ প্রতিরোধের দিকেও জোর দেওয়া জরুরি। ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা (কার্বোহাইড্রেট ও অতিরিক্ত চর্বি এড়িয়ে চলা), ধূমপান পরিহার করা, নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম করা।
বিভ্রান্তিকর রিপোর্টের কারণে ভোগান্তি বাড়ছে রোগীর
মন্জুরুল ইসলাম
নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
দেশের ডায়াগনস্টিক সিস্টেমের বিভ্রান্তির কারণে অধিকাংশ রোগীই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। ভারত ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে গেলে বাংলাদেশের কোনো টেস্টের কাগজ তারা গ্রহণ করেন না। এমনও দেখা গেছে, একজন রোগী তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই টেস্ট করিয়েছেন, তিনটি রিপোর্ট তিন রকম এসেছে। এতে রোগী নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এমনও ঘটনা রয়েছে, যে রোগীকে বাংলাদেশের ডাক্তাররা ক্যানসার আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ভারত কিংবা সিঙ্গাপুরে টেস্ট করানোর পর ডাক্তাররা বলেছেন, আপনার একটি সিস্ট হয়েছে, এটি ক্যানসার নয়। একটি অপারেশনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবার এ দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা জরুরি। একই রকম সমস্যা আমাদের হৃদরোগ চিকিৎসাতেও। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার আরেকটি সমস্যা হলো- প্রত্যেক ধাপে টাকা খরচ করতে হয়। ডাক্তারের কাছে কোনো রোগী গেলে তাকে প্রথমেই ২ হাজার টাকা ফি দিতে হয়। এরপর চিকিৎসক কিছু টেস্ট দেবেন, টেস্টের রিপোর্ট দেখাতে গেলে আবার ডাক্তারকে ফি দিতে হয়। তৃতীয় ধাপে গিয়ে রোগী তার রোগ সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দেন। ডাক্তারদের এই দিকগুলো বিবেচনা করতে হবে। এ সংস্কৃতি থেকে এখনই বেরিয়ে আসতে হবে। এটা ন্যায্য কি না ভাবতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ চাই
মাহমুদ হাসান
যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
দেশ হৃদরোগ চিকিৎসায় উন্নতি লাভ করলেও এ সেবা মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল হৃদরোগীদের বিশ্বমানের সেবা দিচ্ছে। এখনো দেশের সাধারণ হৃদরোগীদের প্রধান ভরসা রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ শহরে হৃদরোগীদের এনজিওগ্রাম, স্টেইন ও বাইপাস সার্জারির ব্যবস্থা নেই। রাজধানীতে যানজটের কারণে হৃদরোগ আক্রান্তদের সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া যায় না। মৃত্যুঝুঁকি কমাতে রাজধানীজুড়ে যৌথভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির স্থায়ী ইমার্জেন্সি হার্ট ক্যাম্প স্থাপন করা জরুরি। সেসব ইমার্জেন্সি ক্যাম্পের অধীনে থাকবে সিসিইউ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর আক্রান্তকে হাসপাতালে পাঠানো হবে। বেসরকারি পর্যায়ে হৃদরোগ হাসপাতাল স্থাপন ও উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা দিতে হবে সরকারকে। হৃদরোগ প্রতিরোধে সবার আগে দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি। এ জন্য গণমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে সারা বছর প্রচারণামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। হৃদরোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসাসেবায় সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের বিকল্প নেই।
সবার জন্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে
অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম
প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস, বগুড়া
আমাদের দেশে যার টাকা আছে তিনি সামান্য সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। যার ফলে যে রোগী গুরুতর অসুস্থ, যার বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রয়োজন, তিনি বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সংকট নিরসনে জেনারেল ফিজিশিয়ান (জিপি) একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। রেফারেল সিস্টেম চালু হলে সবাই সেবা পাবেন। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছে। এ পদ্ধতি কার্যকর করা গেলে সবার যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ডাক্তাররা রোগীর কাছ থেকে টেস্টের আগে এবং পরে দফায় দফায় ফি নিয়ে থাকেন। প্রেসক্রিপশনে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লিখে কমিশন নেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সেসব ডাক্তারের কোনো অভাব নেই। আছে শুধু চাহিদা। এই চাহিদাই আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। এ ধরনের মানসিকতা থেকে ডাক্তারদের বেরিয়ে আসতে হবে। টিএমএসএসের পথচলা শুরু ১৯৬৪ সালে। ভিক্ষুক-গরিবরা মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে এ প্রতিষ্ঠান শুরু করেছেন। তাই আমাদের কার্যক্রমও গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। আমাদের গরিব কৃষক-শ্রমিকরা যাতে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা পান সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে টিএমএসএস।
হার্ট অ্যাটাকে প্রথম ৯০ মিনিট গুরুত্বপূর্ণ
অধ্যাপক ডা. খন্দকার কামরুল ইসলাম
চিফ ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতাল
জীবন একটা, হৃৎপিণ্ডও একটা। আমাদের শরীরে অনেক অঙ্গ আছে। কিছু অঙ্গ কেটে ফেললেও জীবন বেঁচে যায়। কিন্তু হার্ট একবার বন্ধ হলে জীবনও চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এটা মূল্যবান, এর চিকিৎসাও মূল্যবান। হৃদরোগের নানা ধরন আছে, তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো ‘করোনারি আর্টারি ডিজিজ’, যেখানে রক্তনালি ব্লক হয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়। এ অবস্থায় প্রথম ৯০ মিনিটই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে সময় নষ্ট করেন। সিট খালি আছে কিনা, তা জানার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই জরুরি ভিত্তিতে একটি কেন্দ্রীয় ডাটা সিস্টেম দরকার, যেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স খালি সিট থাকা হাসপাতালে রোগীকে নিতে পারবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সেই ইসিজি করে রিপোর্ট পাঠানো সম্ভব, প্রয়োজনে ওষুধ দেওয়া যায়। বিদেশে ভেন্টিলেটরও অ্যাম্বুলেন্সেই দেওয়া হয়, আমাদেরও এ পথে যেতে হবে।
খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার পরিবর্তন জরুরি
অধ্যাপক ডা. মো. মজিবর রহমান সেলিম
প্রকল্প পরিচালক, টিএমএসএস হার্ট সেন্টার, বগুড়া
প্রতি বছর বিশ্বে ২ কোটি মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার ৮০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেক হার্টের সমস্যা এড়ানো সম্ভব। টিএমএসএস হার্ট সেন্টার উত্তরবঙ্গের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তৈরি হয়েছে। এখানে স্বল্প খরচে প্রাইমারি পিসিআই, সিসিইউ এবং কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয়। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ৭৪টি সফল সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত উভয়েই এখানে সেবা পাচ্ছেন। চ্যালেঞ্জ এখনো আছে। এখানে শুধু যে দরিদ্ররাই চিকিৎসা নিতে আসেন এটা সত্য নয়। এখন সামর্থ্যবানরাও টিএমএসএস হার্ট সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসেন। আমরা এখন জায়গা দিতে পারি না। নতুন করে আরও একটি হার্ট সেন্টার বিল্ডিং করার পরিকল্পনা চলছে। স্বাস্থ্যবিমা ও প্রাথমিক স্ক্রিনিং বাড়ালে আমরা আরও বেশি জীবন বাঁচাতে পারব। স্বাস্থ্যবিমা চালু হলে চিকিৎসা খরচের বোঝা কমবে রোগীদের। খুব সহজে হাসপাতালে সেবা নিতে পারবে সবাই।
হৃদরোগে দ্রুত চিকিৎসা জরুরি
অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন
প্রিন্সিপাল, টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ, বগুড়া
আমাদের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে হার্ট অন্যতম। এর কাজ হলো রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গকে জীবিত রাখা। ফলে হার্ট বন্ধ হওয়ার মানেই মৃত্যু। তাই হার্টের অসুস্থতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করা খুবই জরুরি। হৃদরোগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো সচেতনতা নেই। একমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই মানুষকে হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। কেননা বাংলাদেশে হৃদরোগে মারা যাওয়া অধিকাংশ রোগীই মনে করেন এটা গ্যাসের ব্যথা। তারা নানা ধরনের গ্যাসের ওষুধ খেয়েও ব্যথা না কমলে যখন হাসপাতালে যান তখন হয়তো ডাক্তারদের আর কিছু করার থাকে না। তাই বুকে ব্যথা দেখা দিলেই দ্রুত কার্ডিয়াক সেন্টারে যেতে হবে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর হৃদরোগজনিত কারণে ২০ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে। এদের মধ্যেই অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ, যা মোট মৃত্যুর ৭৫ শতাংশ। দেশে কার্ডিয়াক সেন্টার বাড়াতে হবে।
যথাযথ পরিচর্যায় হবে হৃদরোগ প্রতিরোধ
রোটারিয়ান ডা. মো. মতিউর রহমান
উপনির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস, বগুড়া
হৃদরোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে যুবকরা। তবে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি প্রাথমিক ধাপ থেকে তৃতীয় ধাপ পর্যন্ত সব পর্যায়ের রোগীর যথাযথ পরিচর্যা নিশ্চিত করা যায় তাহলে হৃদরোগ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য সরকার, প্রাইভেট সেক্টর ও এনজিওগুলোর মধ্যে সমন্বিত পলিসি গ্রহণ করতে হবে। হৃদরোগের প্রায় ২০ শতাংশ সার্জারি এখন দেশেই করা হচ্ছে। প্রতি বছরই সার্জারির হার বাড়ছে। তবে সার্জারির চাহিদা অনুযায়ী দেশে পর্যাপ্ত মানব সম্পদের অভাব রয়েছে। এর জন্য কান্ট্রি পলিসি গ্রহণ করতে হবে। এর আওতায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সেবাকে কেন্দ্র করে দক্ষ জনবল তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা রাজধানী ও বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদি চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া না যায় তাহলে সবার জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
হৃদয়ের যত্নে সচেতন হতে হবে
ড. মো. চেঙ্গীশ খান
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
হার্ট মানে কেবল হৃৎপিণ্ড নয়, হৃদয়ও। ডাক্তাররা সাধারণত হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসা করেন, কিন্তু যদি হৃদয়ের দিকে মনোযোগ দেন, হৃদরোগ অনেক কমানো সম্ভব। আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে তখন একটি ছোট্ট মাংসপিণ্ড ছিলাম। গর্ভে ষষ্ঠ-সপ্তম সপ্তাহে একটা স্পন্দন তৈরি হয় আর যখন আমি মৃত্যুবরণ করি সেই স্পন্দনটাও শেষ হয়ে যায়। সেই স্পন্দন আমাদের হৃৎপিণ্ড। একজন রোগী যখন একটা মেডিকেল সেন্টারে ঢুকবেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন একটা স্বাস্থ্যবিমার আওতায় স্বয়ংক্রিয় চলে আসেন। অর্থাৎ তিনি যে চিকিৎসা করবেন সেই চিকিৎসার রিপোর্ট সার্ভারে জমা হয়ে যাবে। যাতে পরেরবার চিকিৎসা করাতে গেলে তার চিকিৎসার পুরো ইতিহাস চিকিৎসক জানেন। হার্ট সুস্থ রাখতে প্রয়োজন সচেতনতার। সতর্ক হলে হৃদরোগের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এটি শুধু হৃৎপিণ্ড নয়, হৃদয়ের ভালোবাসা ও যত্নের প্রয়োজন। প্রতিটি হৃদয়কে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসুন।