চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ এখন আর নেই। বর্তমানে চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৩০ হাজার মানুষ কাজের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ তথ্য পাওয়া গেছে খোদ চলচ্চিত্রকারদের কাছ থেকে। নব্বই দশকের শেষভাগে চলচ্চিত্রে যখন অশ্লীলতা, পাইরেসি আর নকল জেঁকে বসে তখন থেকেই নিম্নগামী হতে থাকে এ শিল্পের অবস্থা। এসব নেতিবাচক কারণে তখন দর্শকদের বড় একটি অংশ সিনেমা হল ছেড়েছে। তারা এখনো ফেরেননি। তবে মাঝে-মধ্যে বিশেষ করে বছরের দুই ঈদে হাতে গোনা কয়েকটি মানসম্মত ছবি মুক্তি পেলে সিনেমা হলে কিছু দর্শক ফিরলেও তা দিয়ে সারা বছর সিনেমা হল পরিচালনার মতো অর্থ উঠে আসে না। তাই লোকসান গুনে নাকাল অবস্থায় পড়ে শুরু হয় সিনেমা হল বন্ধের হিড়িক। নব্বই দশকের প্রথমদিকে দেশে থাকা ১৩০০ সিনেমা হল কমতে কমতে এখন এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০টির ঘরে। চলচ্চিত্রশিল্পে যুক্ত প্রায় ৩০ হাজার মানুষ যারা সিনেমা হল পরিচালনা চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিচালনা, পরিবেশনা, সহকারী পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী, ক্যামেরাম্যান, মেকআপম্যান, লাইটম্যান, ভিডিও এডিটর হিসেবে নিয়োজিত। পর্যাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাণের অভাবে তাদের জীবিকা বন্ধ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
পর্যাপ্ত ছবি নেই
সুদীপ্ত কুমার দাস
প্রধান উপদেষ্টা, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে নামমাত্র প্রমোদ কর দিতে হতো, যা এসডিও অফিস সংগ্রহ করত। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে প্রতিটি টিকিট থেকে ৬০ শতাংশ ট্যাক্স নিত সরকার। ১৯৮৩ সালে এসে তৎকালীন সরকার চলচ্চিত্রের ওপর ক্যাপাসিটি ট্যাক্স আরোপ করে। ওই সময় যেমন চলচ্চিত্রের প্রসার ঘটেছিল ঠিক তেমনি সরকারও ট্যাক্স আদায়ের দিকে নজর দিচ্ছিল। কিন্তু যখনই চলচ্চিত্রের পতন শুরু হয় তখন থেকে সরকারেরও নজর কমে গেছে। বর্তমানে ট্যাক্স নয়, ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট দিতে হয়। দীর্ঘ প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ছবি না পাওয়ায় সিনেমা হল চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
প্রায় নির্মাতাই বেকার
ছটকু আহমেদ
নির্বাহী সদস্য, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্য এখন ৩৯৪ জন। সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সিনিয়র চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, প্রযোজক পাওয়া যাচ্ছে না, তাই কাজের অভাবে প্রায় ৯৮ ভাগ পরিচালক এখন বেকার। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা অন্য ব্যবসাবাণিজ্যে চলে গেছে। আর যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, সমিতির ৩৯৪ জন সদস্যের মধ্যে এখন সিনেমা পরিচালনা করছেন মাত্র ১০-১২ জন। এটি দেশের এই প্রধান গণমাধ্যমের জন্য অশনিসংকেত। আমি মনে করি প্রযোজকরা যদি এগিয়ে আসেন, মানসম্মত ছবি নির্মাণ করেন তাহলে সিনেমা হলে আবার দর্শক ফিরবে এবং এতে নতুন সিনেমা হল নির্মাণে আগ্রহ বাড়বে।
অসহায় শিল্পীরা
মিশা সওদাগর
সভাপতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি অভিনেতা মিশা সওদাগর জানান, এই সমিতির সদস্য এখন পৌনে ছয় শর মতো। কিন্তু প্রযোজকের অভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ শতকরা ৯-১০ ভাগে নেমে আসায় সমিতির শিল্পীদের কাজও এই হারে এসে ঠেকেছে। স্বাভাবিকভাবেই কাজ না থাকায় সিংহভাগ শিল্পী এখন বেকার ও অসহায়ত্বের কবলে পড়েছেন। আমি মনে করি সিনেমা শিল্পের সুদিন ফেরানো কোনো কঠিন কাজ নয়। সরকার ও এই শিল্পের মানুষের সদিচ্ছাই এর জন্য জরুরি। সরকার যদি সিনেমা শিল্পকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এই শিল্পের সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখে তাহলে প্রযোজকরা সিনেমা নির্মাণে সাহস পাবেন। এতে চলচ্চিত্রের প্রতিটি মানুষ আবার নতুন উদ্যমে ফিরবে।
যৌথ প্রযোজনা বন্ধ
কামাল কিবরিয়া
সাবেক প্রযোজক কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি
সাবেক চলচ্চিত্র প্রযোজক নেতা কামাল কিবরিয়া লিপু বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্র ধ্বংসের জন্য যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া প্রধান কারণ। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শাকিব খান ছাড়া আর কারও সিনেমা চলছে না। তার উচ্চ পারিশ্রমিক দাবির কারণে সবাই তো তাকে নিয়ে কাজ করতে পারছে না। কারণ আমাদের দেশে সিনেমা হল কম। তাই ব্যবসার বাজার ছোট। এ অবস্থায় বিগ বাজেটের ছবি নির্মাণ করে লোকসান গুনতে হবে বলে প্রযোজকরা নির্মাণে সাহস পাচ্ছেন না। তা ছাড়া চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির নির্বাচন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। তাই নির্বাচিত কমিটি না থাকায় চলচ্চিত্র প্রযোজনায় অভিভাবকত্বহীনতা ও বিশৃঙ্খলা চলছে। তিনি আরও বলেন, সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান দিয়ে আসছে। কিন্তু স্বল্প টাকার এ অনুদান দিয়ে কি একটি মানসম্মত ছবি নির্মাণ সম্ভব। তা ছাড়া অনুদানের টাকা নিয়ে সবাই কি আসলেই ছবি নির্মাণ করছে। সরকারি টাকা নিয়ে নয়ছয় বন্ধ করতে রহস্যজনক কারণে সরকারের জোরালো ভূমিকাও নেই। তাই সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রের মানুষ একাধারে বেকার হচ্ছে এবং গভীর সংকটে পড়েছে চলচ্চিত্রের মতো একটি প্রধান রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
সিনেমা হল কোথায়
খোরশেদ আলম খসরু
সাবেক প্রযোজক কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি
সাবেক চলচ্চিত্র প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘ছবি বেশি নির্মাণ হলে অভিনয়শিল্পীরাও কাজের সুযোগ পাবেন। ছবি কেমন চলবে না চলবে এটা পরের ব্যাপার। আগে তো ছবি নির্মাণ করতে হবে, সেটাই তো হচ্ছে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে সিনেমা হল সংখ্যা কমে যাওয়া। ১ হাজার ৩০০ সিনেমা হলের মধ্যে এখন নিয়মিত খোলা থাকে ৪০-৫০টি। এই স্বল্পসংখ্যক সিনেমা হল দিয়ে তো পুরো ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সিনেমা তৈরি করে প্রযোজক যদি হল না পান, খরচের টাকা তুলতে না পারেন তাহলে ঘাটতি দিয়ে কয়টি সিনেমা বানাবেন তিনি? ঘাটতি দিয়ে সিনেমা বানানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখতে সিনেমা বানাতে হবে, সিনেমা হল বাড়াতে হবে, বিগত সরকার সিনেমা হল নির্মাণে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বরাদ্দ দেয়। সেই টাকা সহজ শর্তে প্রদান করলে সিনেমা হল বাড়বে। নির্মাতারাও এগিয়ে আসবেন। তাতে চলচ্চিত্রে সবার কাজে ব্যস্ততা বাড়বে। দূর হবে এই শিল্পের সংকট।’
প্রযোজকের অভাব
শাহীন সুমন
সভাপতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব শাহীন সুমন বলেন, ‘সিনেমা হল কমে যাচ্ছে। ভালো ছবির অভাবে দর্শক হলে আসছে না। তাই প্রযোজকরা অর্থলগ্নি করতে সাহস পান না। ছবি কম নির্মাণ হচ্ছে। ফলে পরিচালকরা বেকার হয়ে পড়ছেন। কাজের অভাবে তারা অসহায়ত্বের কবলে পড়েছেন। এ অবস্থা আমাদের দেশের এই প্রধান গণমাধ্যম সিনেমা শিল্পের জন্য মোটেও কাম্য নয়। এ কারণে এখন ভালো ভালো শিল্পীদের হাতেও নতুন কাজের অভাব। আমি মনে করি এ সমস্যার সমাধানে চলচ্চিত্রের সব পক্ষের মানুষের একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শিল্পটিকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। তা ছাড়া এর উত্তরণে নির্বাচিত প্রযোজক সমিতি গঠন করা জরুরি। এর জন্য প্রযোজকদের এগিয়ে আসা, ভালো ছবি নির্মাণ এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। আমি মনে করি প্রদর্শক এবং প্রযোজক যদি এ শিল্পের বন্ধ্যত্বমোচনে সচেতন হন তাহলে চলচ্চিত্রের সুদিন আবার ফিরবে, এ শিল্পের বেকারত্ব দূর হবে।