বাবাকে খাবার পৌঁছে দিতে বাসা থেকে বের হলে ছেলে মুসা আইসক্রিম খেতে চায়। তখন আমার মা ও ছেলেকে নিয়ে বাসার নিচে নামি। বাসার নিচে নামার পরই গেটের বাইর থেকে পুলিশের গুলি এসে আমার ছেলের মাথা ভেদ করে বের হয়ে যায়। সেই একই গুলি লাগে আমার মায়ের পেটে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মা মারা যান। আমার ছেলেরও এখন এক পাশ প্যারালাইজড (পক্ষাঘাতগ্রস্ত)।
জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন সাক্ষী মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল এ মামলায় প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। পরে তাঁকে জেরা শেষ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৩ নভেম্বর দিন ধার্য করেন ট্রাইবু্যুনাল।
কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন প্রশ্নে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষ হয়েছে। রামপুরার ঘটনার এই মামলায়ে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ মোট আসামি পাঁচজন। এর মধ্যে একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। পলাতক বাকি তিন আসামি হলেন খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া।
জবানবন্দির শুরুতেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেন ছয় বছর বয়সি গুলিবিদ্ধ মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গত বছর ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকাল আনুমানিক তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার সময় আমার বাবাকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার ছেলে মো. বাসিত খান মুসা আইসক্রিম খেতে চায়। তখন আমি আমার মা ও ছেলেকে নিয়ে বাসার নিচে নামি। মাকে বলি আইসক্রিম কিনে দেওয়ার পর আমার ছেলেকে নিয়ে মা যেন বাসায় চলে যায়। বাসার নিচে নামার পর গেটের বাহির থেকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি আমার ছেলের মাথা ভেদ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। আমি তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেকে কোলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ফেমাস হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে গত বছর ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে ভর্তি ছিল। পরে তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে আইসিইউতে ছিল। ছেলের অবস্থার অবনতি হতে থাকলে চিকিৎসকেরা তাকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর পরামর্শ দেয়। ২৩ অক্টোবর থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ছেলের চিকিৎসা চলে। ৯ জুলাই পুনরায় সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। এই দফায় ২৬ জুলাই পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। ছেলের ডান দিক এখন প্যারালাইজড। কথাও বলতে পারে না। চলাফেরাও করতে পারে না।’ এ পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সাক্ষী মায়ের হত্যা ও ছেলের এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার চান।
এই ট্রাইব্যুনালে কোনো অস্বচ্ছতা নেই : বর্তমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো অস্বচ্ছতা নেই এবং ক্যাঙারু কোর্ট মনে করেন না বলে মন্তব্য করেছেন রামপুরার মামলায় আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। গতকাল দুপুরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। আমির হোসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষেও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে রয়েছেন।
হানিফসহ চারজনের অভিযোগ গঠন প্রশ্নে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষ : জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষ হয়েছে।
গতকাল বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। পরে আসামিপক্ষের শুনানির জন্য আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার অন্য তিন আসামি হলেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খান, জেলা সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা। তবে চারজনই পলাতক।
সেনা কর্মকর্তাদের চাকরি নিয়ে প্রসিকিউটরের বক্তব্য ভুলভাবে উদ্ধৃত : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি সেনা কর্মকর্তাদের চাকরি নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম যে বক্তব্য রবিবার দিয়েছিলেন, তা গণমাধ্যমে ভুলভাবে উদ্ধৃত হয়েছে- বলছে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। গতকাল এই কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানার স্বাক্ষর করা একটি বিজ্ঞপ্তি ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেন প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল নোমান। চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘সেনা সদর দপ্তর আইন প্রয়োগ না করা পর্যন্ত আসামি ১৫ সেনা কর্মকর্তা কর্মরত : প্রসিকিউটর’ শিরোনামের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে প্রসিকিউটর গাজী তামীমের বক্তব্যকে ভুলভাবে উদ্ধৃত ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যার ফলে জনমনে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে, আইনটি এখনো প্রয়োগ হয়নি বা সেনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর আইনের প্রয়োগ নির্ভর করছে, যা বাস্তবতা ও আইনের ভাষার পরিপন্থি।’