জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে সংঘটিত হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গুলিতে নিহত শাহারিয়ার খান আনাসের
মা সানজিদা খান দীপ্তি। জবানবন্দিতে চিঠি লিখে আনাসের আন্দোলনে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। চেয়েছেন ছেলে হত্যার দায়ে আসামিদের ফাঁসি।
গতকাল বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের নবম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। এদিন প্রসিকিউশনের দশম সাক্ষী মো. রাব্বি হোসেন, একাদশ সাক্ষী মো. আবদুল গফুর ও দ্বাদশ সাক্ষী মো. টিপু সুলতান তাদের জবানবন্দি দেন। পরে তাদের জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১১ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে সকালে কারাগার থেকে এ মামলার চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। জবানবন্দিতে আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে একটি চিঠি লিখে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ভাড়া বাসা থেকে বের হয়েছিল আনাস। চিঠিতে আনাস লিখেছিল ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে গর্বিত হইও।’ ঠিক দুপুরে তার মৃত্যুর খবর পাই আমরা। পরে তার লাশ আনতে মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। সঙ্গে তার বাবা এবং নানাও ছিলেন। লাশটি নিয়ে রিকশায় করে বাসার উদ্দেশে রওনা দিই আমরা। ওই সময় আনাসের রক্তে আমাদের তিনজনের শরীর ভেসে গিয়েছিল। তিনি বলেন, বাসায় আনার পর লাশ নিয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মিছিল করেন এলাকাবাসী। পরে ধুপখোলা মাঠে তার জানাজার আয়োজন করা হয়। সেখানে মেহেদী হাসান জুনায়েদের জানাজা হয়েছে বলে আনাসের বাবার কাছ থেকে জানতে পারি। দুজনেরই জানাজা একসঙ্গে হয়। তবে স্থানীয় আলেমের পরামর্শে রক্তাক্ত কাপড়ে গোসল ছাড়াই শহীদি মর্যাদায় আনাসকে দাফন করা হয়। আন্দোলনকারী রাব্বী ও সৌরভের বরাত দিয়ে এই সাক্ষী বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টায় হাজারো আন্দোলনকারীর সঙ্গে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল আনাস। কিন্তু চানখাঁরপুলে তারা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হয়। ওই সময় গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ-র্যাব। এতে প্রাণ রক্ষায় চানখাঁরপুলের নবাব কাটারাসহ বিভিন্ন গলিতে আশ্রয় নেয় আন্দোলনকারীরা। আনাসও সেখানে ছিল। একপর্যায়ে আমার ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন একজন পুলিশ সদস্য। গুলিটি বুকে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় আনাস। পরে আন্দোলনকারী কয়েকজন মিলে তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নেয়। কারণ রিকশাই ছিল ওই সময়ের অ্যাম্বুলেন্স। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে গুলিবর্ষণকারীসহ নির্দেশদাতাদের নাম জানতে পারেন বলে জবানবন্দিতে তুলে ধরেন দীপ্তি। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে চানখাঁরপুলে হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ও রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম। আর তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। তারা সেদিন নির্বিচারে গুলি চালিয়েছেন। এমন ভয়াবহভাবে গুলি চালিয়েছিলেন, যেন মানুষ না বাঁচতে পারে। তাদের গুলিতেই চানখাঁরপুলে আমার ছেলে আনাসসহ ছয়জন শহীদ হয়। এ ছাড়া এই গুলির নির্দেশদাতা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। আমি হত্যার বদলে হত্যা চাই। এসব আসামির ফাঁসির আদেশও চাই। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, মোস্তাকিম, ইয়াকুব, ইসমামুলসহ কয়েকজন পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি। এটিই ছিল জুলাই-আগস্টের গণ আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। পরে গত ২৫ মে এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। এ মামলায় ৭৯ জনকে সাক্ষী করেছে প্রসিকিউশন। পরে গত ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।