গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কয়েক ঘণ্টা আগে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় গেন্ডারিয়া উইল পাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ (মোস্তাকিম)। একটি বুলেট তার ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেদিন প্রায় একই সময়ে আরও কয়েকজন নিহত হয় এখানে। চানখাঁরপুলের এই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে জবানবন্দির একপর্যায়ে অঝোরে কেঁদেছেন মোস্তাকিমের বাবা শেখ জামাল হাসান। আর্তনাদ করে তিনি বলেন, ‘আমার ১৪ বছর বয়সি একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে আমি ও আমার স্ত্রী পাগলের মতো জীবন যাপন করছি। আমি দায়ীদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’ গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি দেন এ মামলায় প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা ৫৪ বছর বয়সি শেখ জামাল হোসেন। তার আগে জবানবন্দি দেন প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আঞ্জুয়ারা ইয়াসমিন। তিনি জবানবন্দিতে নিজের চানখাঁরপুলের বাসার ছাদ থেকে দেখা ৫ আগস্টের ঘটনার বর্ণনা দেন।
পরে আসামি আরশাদ হোসেনের পক্ষে সাক্ষীকে জেরা করেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। ইমাজ হোসেনের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী জিয়াউর রশিদ টিটো, আসামি সুজন হোসেন ও নাসিরুল ইসলামের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী আবুল হোসেন। আর পলাতক আসামিদের পক্ষে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুবুদ্দিন। পরে এ মামলায় আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। এ সময় প্রসিকিউশন পক্ষে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, তারেক আবদুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জবানবন্দিতে নিহত মোস্তাকিমের বাবা শেখ জামাল হাসান বলেন, ‘২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমি, আমার ছেলে এবং আমার পরিবারের সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক পৌনে ১১টার দিকে আমার ছেলে শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ (মোস্তাকিম) তার বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পরে আমার স্ত্রী এবং মেয়েও বাসা থেকে বের হয়ে গিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করে।’
তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ‘বেলা আনুমানিক পৌনে ২টার দিকে আমার শ্যালক আসিফ আমাকে ফোন করে বলে মোস্তাকিম গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার কথা বিশ্বাস না করে বাসা থেকে বের হয়ে গেন্ডারিয়া ধূপখোলা মাঠে এবং পার্শ্ববর্তী আজগর আলী হাসপাতালে গিয়ে খুঁজতে থাকি। বেলা ২টার দিকে আমার ভাতিজি শম্পা আমার মোবাইলে ফোন করে আমাকে বাসায় যেতে বলে, জানায় মোস্তাকিমের লাশ বাসায় আনা হয়েছে। আমি বাসায় গিয়ে দেখি আমার ভাই আবদুর রহমানের ফ্ল্যাটে আমার ছেলে মোস্তাকিমের নিথর দেহ পড়ে আছে। আমি লক্ষ করে দেখলাম তার বাম চোখে গুলি লেগে মাথার পিছন দিকে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে যায়।’
নিহত মোস্তাকিমের বন্ধু সিয়ামের বরাত দিয়ে ঘটনার সম্পর্কে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘চানখাঁরপুল নবাব কাটরা এলাকায় হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের পিছনের রাস্তার ওপর মিছিলরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে মোস্তাকিম। শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের দিক থেকে পুলিশ মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।’
আবদুর রউফ নামে আরেক আন্দোলনকারীর বরাত দিয়ে শেখ জামাল হাসান বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ মোস্তাকিমকে মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ডাক্তারদের পীড়াপীড়িতে লাশ দ্রুত বাসায় নিয়ে আসতে হয়েছে। ডাক্তাররা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে লাশ হাসপাতালে রাখা যাবে না। তাড়াতাড়ি লাশ না নিয়ে গেলে তারা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে দিয়ে দেবে, নয়তো বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়।’
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘মোস্তাকিমের জানাজার জন্য আসরের নামাজের আগে আমরা ধূপখোলা মাঠে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি শাহরিয়ার খান আনাসের লাশও আনা হয়েছে। জানাজা শেষে দুজনকেই গেন্ডারিয়া জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা থানার এডিসি আক্তারুল ইসলামের নির্দেশে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। কনস্টেবল সুজন এবং নাসিরুল টার্গেট করে আমার ছেলেকে এবং মিছিলের ওপর গুলি করে।’
এ সময় সাক্ষী শেখ জামাল হাসান অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তিনি আর্তনাদ করে বলেন, ‘আমার ছেলে ১০ পারা কোরআনের হাফেজ ছিল। ওর কী অপরাধ ছিল? আমি ছেলে হারানোর বেদনায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি।’
সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে ঘুম ভাঙে : রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আঞ্জুয়ারা ইয়াসমিন গত বছর ৫ আগস্ট বাসার ছাদ থেকে দেখেছেন চানখাঁরপুলের ঘটনা। নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করেছেন অনেক কিছু। ৪৮ বছর বয়সি এই শিক্ষিকা গতকাল চানখাঁরপুল মামলায় প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন ট্রাইব্যুনালে। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। চানখাঁরপুল মোড়েই আমার বাসা। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পুলিশ মাইকে স্থানীয় লোকজনকে ঘর হতে বের হতে নিষেধ করছে। ওই দিন আন্দোলনকারীদের “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচি ছিল। আমি আমার ছাত্রদের ফোন করে কর্মসূচির বিষয়ে জানতে পারি যে তারা শহীদ মিনারে প্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশ শহীদ মিনারে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে বাসার ছাদে উঠে দেখি চানখাঁরপুল মোড়ে ছাত্র-জনতা সবাইকে বের হয়ে আসার জন্য আহ্বান করছিল। ওই সময় পুলিশের কয়েকটি গাড়ি আসে এবং গুলি করতে থাকে। তখন আন্দোলনকারীরা হোসনি দালান রোড, নাজিমুদ্দিন রোডসহ আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়। পুলিশ বিভিন্ন দিকে থাকা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে। আনুমানিক সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে চানখাঁরপুলস্থ নিমতলী গলির বাখরখানির দোকানের সামনে একটি ছেলেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। আন্দোলনকারীরা তাকে অটোরিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
এই শিক্ষিকার মোবাইলে ধারণ করা এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ক্লিপ ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়।
গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আনাসসহ কয়েকজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ৬ মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি। এটিই ছিল জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। পরে ২৫ মে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। এ মামলায় ৭৯ জনকে সাক্ষী করেছে প্রসিকিউশন। পরে ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।