ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা ফেরানোর তাগিদ দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া ‘মব ভায়েলেন্সের’ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। গতকাল নির্বাচন কমিশন আয়োজিত সকাল ও বিকালের সংলাপে এসব পরামর্শ দিয়েছেন সমাজের বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, যে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতিতে’ বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়েছে, তাতে গতানুগতিক নির্বাচন করলে কী হবে তা ‘অনুমেয়’; তাই আগামীতে যে কোনো সময় মব সৃষ্টির শঙ্কায় সতর্ক থাকার তাগিদ দিয়েছেন তারা। পোস্টাল ভোটিংকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া অপতথ্য ছড়ানোর বিষয়ে এবং এআইয়ের প্রভাব রুখতেও সজাগ থাকার কথা বলেছেন প্রতিনিধিরা। কোনো চাপের মুখে কোনো দলকে শাপলা প্রতীক না দিতে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মত না দেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন প্রতিনিধিদের অনেকে। নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল প্রথমবারের মতো অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপে বসে এ এম এম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সকালে সুশীল সমাজ ও বিকালে শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। সংলাপে নাগরিক সমাজ প্রতিনিধি ও শিক্ষাবিদরা নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন।
নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সকাল ও বিকালের সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে চার নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ও ইসি সচিব আখতার আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
সকালের সংলাপে আমন্ত্রিতদের মধ্যে ১৩ জন আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন- সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাহমুদ হাসানউজ্জামান, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. মাহফুজুর রহমান, অধ্যাপক আবদুল ওয়াজেদ, বিজিএমইএ পরিচালক রশিদ আহমেদ হোসাইনি, কবি মোহন রায়হান, পুলিশ রিফর্ম কমিশনের মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জারিফ রহমান, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, টিআইবি পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন স্বাগত বক্তব্যে উপস্থিতিদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে এ সংলাপ ভূমিকা রাখবে আশা করি। বিশ্বাসযোগ্য সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনাদের মতামত ইসির কাজকর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সহযোগিতা চেয়ে সিইসি বলেন, অনেক কাজ শেষ করেছি। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পাশাপাশি আইনি সংস্কার করেছি। সুষ্ঠুভাবে ভোট করার জন্য অনেক এগিয়ে গেছি। এ সংলাপ শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়। দেরিতে সংলাপ শুরু করলেও ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করে ইসির কাজ হালকা হয়ে গেছে। যেটুকু গ্যাপ আছে সেটুকু আপনারা ফিলআপ করে দেবেন। প্রবাসীদের জন্য আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিংয়ের উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের ভিতরে ভোটে নিয়োজিত ১০ লাখের বেশি লোকবলের জন্য ভোটের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি কর্মকর্তা, আইনে হেফাজতে থাকা লোক ভোট দিতে পারবে। যা এবার মাইলফলক হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, হালনাগাদে আমরা প্রায় ২১ লাখ মৃত ভোটার কর্তন করতে পেরেছি।
বিবিএসের তথ্য প্রশ্নবিদ্ধ, দেশের জনসংখ্যা এখন ১৯ কোটি- ইসি তাহমিদা : সংলাপে নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৯ কোটি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায়ই রয়েছে ১ কোটি ৫১ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) দেওয়া তথ্যকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলেও মন্তব্য করেন ইসি তাহমিদা। তিনি বলেন, জনসংখ্যা নিয়ে বিবিএসের ডেটা প্রশ্নবিদ্ধ। একবার তারা যেটা প্রকাশ করল, পরে আবার সেটা কমিয়ে দেখানোর জন্য বলা হয়েছে।
সংলাপে তাহমিদা আহমদ বলেন, আমরা যে ভোটার তালিকা করলাম বাড়ি বাড়ি গিয়ে, সেখান থেকে তথ্যটা পেয়েছি। এটা একদম ঠিক তথ্য। আমাদের লোকসংখ্যা হলো ১৯ কোটি। এর মধ্যে ১ কোটি ৫১ লাখ বাইরে, প্রবাসী যেটাকে বলা হয়। শুধু ঢাকায় রয়েছে ১ কোটি ৫১ লাখ মানুষ।
সংলাপে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, এ নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ ও অর্জনের বিষয় হচ্ছে সফলভাবে নির্বাচন করা। দেশের জন্য এটা ট্রানজিশন, এর সফলতার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। ৭০-এর নির্বাচন যেমন টার্নিং পয়েন্ট ছিল, এবারের নির্বাচনটিও টার্নিং পয়েন্ট হবে। তিনি বলেন, ইসিকে উঁচু নৈতিক মানদণ্ডে দেখতে চাইবে মানুষ। দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচন মানুষের প্রত্যাশা। কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়ন ও দক্ষ করতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত যেন নিতে পারে। এবারের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। গেল ১৫ বছরে ‘ভায়োলেন্স নরমালাইজেশন’ হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
হুমায়ুন কবির বলেন, এবারের নির্বাচনে ক্যাম্পেইন সোশ্যাল মিডিয়ায়, অনলাইনে হবে ৮০%। এটার জন্য ইসি কতটুকু প্রস্তুত? মিথ্যা তথ্য, অপতথ্য, এআই জেনারেটেড তথ্য আসবে। নির্বাচনের আগেই অনেক উত্তেজনা করবে সোশ্যাল মিডিয়া। তিনি মনে করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে কৌশল হাতে রাখতে হবে। ভোটের পরেও ফলাফল বিভ্রান্ত করতে অনেক কিছু করা হতে পারে। উন্নত দেশও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌসের ভাষ্য, ৫৪ বছরেও ক্ষমতার ট্রানজিশন কেমন হবে তা আমরা ঠিক করতে পারিনি। তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতির পরিণতি আপনারা দেখেছেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পরিণতি আপনারা দেখেছেন। আইনশৃঙ্খলায় পুলিশের আস্থা নেই। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন এক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছেন- সিইসির ভাষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চ্যালেঞ্জে আছেন। কমিশনকে স্বাধীনভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে নির্বাচন উপহার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। যদি সাহসী হতে পারেন, সত্যি মেরুদণ্ড থাকে তাহলে স্বাধীন হতে পারবেন। স্বাধীন হলে জাতিকে সুন্দর. ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারবেন। অতীতে সব কমিশন নিজেদের স্বাধীন ও মেরুদণ্ড শক্ত দাবি করলেও সেটার বাস্তবায়ন ‘দেখাতে পারেনি’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। পুরো বিশ্ব আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্য ভোটার তালিকা, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং আচরণবিধি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন। দলগুলোর মনোনয়নবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমে অবাধ তথ্য প্রবাহ দিতে হবে। জাতীয় ও দেশি পর্যবেক্ষক বাড়াতে হবে। সাহসের বিকল্প নেই, সাহসী হন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বলেছেন, গেল ১৫-২০ বছরে প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের কার্নিশে। যার যা খুশি করেছেন। এমন ‘ভয়াবহ’ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারলে ইতিহাসের পাতায় ইসির নাম লেখা থাকবে বলে মনে করেন তিনি। বিগত সময়ে রাতের ভোট, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এবারের ইসির বিরুদ্ধে ‘তেমন অভিযোগ নেই’। এটা বড় শক্তি। দলীয় সরকারের অধীনে এ ইসি নয়। এখনকার নির্দলীয় সরকার। এ সরকারের কোনো দল নেই। এ শিক্ষক জানিয়েছেন, পোস্টাল ভোটিংয়েরে নতুন চ্যালেঞ্জ। বিতর্কিত হওয়ার অনেক সুযোগ। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমলাদের বাইরে রেখে নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন। পিআর ভোট পদ্ধতি সচেতনতা সৃষ্টি না করে কোনোভাবে পদ্ধতিটির পক্ষে অবস্থান না নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। শাপলা প্রতীক নিয়ে এনসিপির দাবির বিষয়টি ইঙ্গিত করে এ অধ্যাপক বলেছেন, ইসি যে প্রতীক দেয় সে প্রতীকেই ভোট করতে হবে। বিশেষ মার্কা না দিলে ভোটে রাজি না এমন দাবি- এটা ঠিক না। স্বাধীন ইসির নিজস্ব এখতিয়ার এটা। ইসিকে চাপ দেবেন না। মার্কা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনো অধিকার নেই। স্থানীয় নির্বাচন না করে জাতীয় নির্বাচন করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
আরপিও সংস্কারের বেশ কিছু প্রস্তাবনার বিষয়ে ভিন্নমত দিয়ে টিআইবি পরিচালক বদিউজ্জামান বলেছেন, হলফনামার তথ্য যাচাইবাছাইয়ের কার্যকর ব্যবস্থা ও আচরণবিধি প্রয়োগের ‘দুর্বলতা রয়েছে’। নির্বাচনি ব্যয় তদারকি ও প্রকাশের বিষয়ে ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দেন তিনি। ‘না’ ভোটের বিধান শুধু একক প্রার্থীর আসনে নয়, সব আসনে ব্যবস্থা রাখা জরুরি। নারী মনোনয়ন বাড়াতে দলগুলোর প্রতিশ্রুতি ও প্রচারণায় তহবিল করার অনুরোধ করেন তিনি।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আবদুুল ওয়াজেদ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন। তিনি বলেন, এ সরকারের ভিন্ন ক্যারেক্টার রয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, ভোটের আগে ভোটের সময় ও পরে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, অতীতে যারা জিততে পারেনি, নারী ও শিশুর প্রতি তাদের নির্যাতনের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
সংলাপে আসা সব পরামর্শ আমলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইসি অনেক কাজ করেছেন। তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশার সঙ্গে নবীন প্রবীণ ধনী দরিদ্র সবার কথা মনে রাখতে হবে, যেন ভুলে না যাই। আস্থার সংকট তৈরি হয়ে গেছে। নারীর বিষয়ে প্রচণ্ড রকম ক্ষোভ রয়ে গেছে। ৫১% নারী, অথচ আসন ৫-৭% নারীর প্রতিনিধিত্ব। আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছি। নির্বাচনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, বারবার বলব, পাঁচ থেকে সাত পারসেন্ট আমরা মানি না। সব আসনে ‘না’ ভোট চালুর পক্ষে মত দেন তিনি।
হারুন চৌধুরী বলেন, এখনো শঙ্কা মানুষের মধ্যে সুষ্ঠু ভোট হবে নাকি আগের মতো? মহিলা ভোট কেন্দ্রের জন্য মহিলা পুলিশ রাখার পরামর্শ দেন তিনি। নারী ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান পুলিশ সংস্কার কমিশনের এ সদস্য।
সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজুর রহমান বলেছেন, ভোটের আগে বাহিনীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হবে। অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানউজ্জামান বলেছেন, ‘আস্থা অর্জনই প্রধান সমস্যা’। এটা তৈরি করা ইসির প্রধান দায়িত্ব। আইনানুগভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসিকে প্রমাণ করতে হবে, নিরপেক্ষ ভোট আয়োজন করতে হবে। ভুয়া তথ্য রোধে ইসিকে বড় ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন তিনি। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান শাপলা প্রতীক কোনো দলকে না দেওয়ায় ইসির কঠোর ভূমিকার প্রশংসা করেন।
বিজিএমইএ পরিচালক রশিদ আহমেদ হোসাইনি জানান, মেরুদণ্ড শক্ত-মেরুদণ্ডহীনের কথা বলেছে অনেকে, সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আইনের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো গেলে ভালো নির্বাচন দিয়ে ইসি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারবে।
শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জায়িফ রহমানের কথায় নির্বিঘ্ন ভোটের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ইসি দৃশ্যমান উদ্যোগ নিলে জনগণের মধ্যে ভরসা বাড়বে ইসির প্রতি। মিস ইনফরমেশন, এআই জেনারেটেড তথ্যের অপব্যবহার রোধে তৎপর থাকার অনুরোধ করেন শিক্ষার্থী।
সংলাপে অংশ নিয়ে সাংবাদিক ও কবি সোহরাব হাসান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমাদের আস্থা আছে কি না, এটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই কমিশন মনে করে কি না যে বর্তমান সরকারের আমলে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা সম্ভব? যদি মনে করে, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে পরবর্তী নির্বাচনের দায় নিতে হবে।’
নির্বাচন কমিশন কিছু কিছু বিতর্ক এড়াতে পারত উল্লেখ করে সোহরাব হাসান বলেন, ‘একটা পক্ষকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ধরে নিলাম, তারা নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনে বসেছে, তাদের মধ্যে যদি কেউ মনে করেন যে পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বা আমরা জিতব না, সুতরাং আমরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম। তাহলে কী পরিস্থিতি হবে, আপনারা ভেবে দেখুন।’
সিইসি নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে চান : সমাপনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আমরা নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে চাই। সবাই যাতে দেখতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চাই। নির্বাচনে সবার সহযোগিতা নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সিইসি বলেন, আমরা চেষ্টা করব আপনাদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করার। আপনাদের সবার সহযোগিতা নিয়ে সুন্দর নির্বাচন করতে পারব। মানুষকে বলেন যাতে তারা নির্বাচনে আসে। আমরা সুষ্ঠু সুন্দর, স্বচ্ছ নির্বাচন করব। আমাদের সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। সবাইকে লিখিতভাবে হলেও পরামর্শ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সিইসি। এ সময় ফোনালাপ ফাঁসের ভয়ে ‘ফোন ধরেন না’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। অনেকের ফোন কল ধরি না। কল ফাঁসের ভয়ে ফোনে কথা বলি না। কিন্তু আমাদের দরজা খোলা। যে কোনো সময়ে আপনাদের সুপারিশ আমরা গ্রহণ করব।
ভোটকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করবে ‘দুষ্কৃতকারীরা’ : প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, যারা নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে চায়, তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। নির্বাচন ভবনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আয়োজিত বিকালের সংলাপের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এমন মন্তব্য করেন। সংলাপে শিক্ষাবিদ, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিষয়ে সিইসি বলেন, আমাদের টেকনোলজি মাইট ফেইল। সাইবার সিকিউরিটি মেবি অ্যাট স্টেক, হ্যাকিং হতে পারে। এ প্রশ্নগুলো কনসালট্যান্টকে করেছিলাম। যদি নির্বাচনের দিন আমাদের এটা হ্যাক হয়ে যায়, তারপর কী হবে। আর উই প্রিপায়ার্ড টু রেইজ দিস।
তিনি বলেন, যদি তারা সাইবার অ্যাটাক করে, ম্যালওয়ার ঢুকায়ে দেয়...যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভই সেইফ না, সেখানে আমার পোস্টাল ব্যালট কতটুকু সেইফ বুঝতে হবে। পোস্টাল ব্যালটে কী কী চ্যালেঞ্জ হতে পারে তা বের করতে নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে সিইসি বলেন, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট মে রেইজ ডিবেটস। এটা পরের দিকে ডিবেট হতে পারে। ইট মে রেইজ লট অব কোয়েশ্চেনস এজ ওয়েল। এটা আমরা জানি। তবে তারা (কনসালট্যান্ট) আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, যে ব্যবস্থা নেবেন।
বিকালের সংলাপে অংশ নিয়ে সংসদ নির্বাচনে গণমাধ্যমের সম্পৃক্ততা বাড়াতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমদ। বলেন, অলরেডি আপনাদের কিছু সুনাম অর্জন হয়েছে। বিশেষ করে ভোটার তালিকার ব্যাপারে। আইটি সাপোর্টের পোস্টাল ব্যালট এবং প্রত্যেকটা ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।
নির্বাচনে রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠায় দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনি আচরণবিধি প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রচুর ভুয়া তথ্য, ভুল তথ্য, ফেক ইমেজ এবং এআইনির্ভর বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ছে। নির্বাচনের সময় এগুলোর প্রভাব আরও বাড়বে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) সিস্টেমের জন্য আমাদের এখানে যে জিনিসটা দরকার তা এখনো বাংলাদেশ সেটার জন্য প্রস্তুত নয়। এ ছাড়া সংলাপে অংশ নিয়েছেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান, ঢাবি অধ্যাপক লায়লা নুর, অধ্যাপক শামীম রেজা, ঢাকা কলেজ অধ্যক্ষ এ কে এম ইলিয়াস, অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা সালমা, ড. আবদুুল্লাহ আল মামুন, অধ্যাপক সাহাব এনাম খান, অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী।