বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশ ও জনগণের স্বার্থে এক থাকতে হবে। এ সময় কোনো ইস্যুতেই রাজনীতিবিদদের মুখ দেখাদেখি যেন বন্ধ না হয়। রাজনৈতিক দলের সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ থাকবে। এসব মতভেদ দূর করতে আমাদের আলোচনা চলবে। জাতীয় কোনো ইস্যুতে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যাতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ না হয়, সে লক্ষ্যে জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। কারণ আমি বিশ্বাস করি- ‘ধর্ম, দর্শন, মত যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার।’ এ সময় দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করতে সবার সহযোগিতা ও সমর্থন চান তিনি। গতকাল বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দলের বিজয় র্যালি শুরুর প্রাক্কালে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান এসব কথা বলেন। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিএনপি এ বিজয় র্যালি বের করে। বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টনের সামনে থেকে এ র্যালি শুরু হয়।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিজয় র্যালির উদ্বোধন করেন। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিজয় র্যালিটি নয়াপল্টন থেকে শুরু হয়ে বিজয়নগর, পুরানা পল্টন মোড়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ গিয়ে শেষ হয়। র্যালিতে পিকআপ ভ্যানে চড়ে যোগ দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাহউদ্দিন আহমেদসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা। র্যালি শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই নয়াপল্টন এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেন দলটির নেতা-কর্মীরা। বিএনপি ছাড়াও যুবদল, ছাত্রদলসহ অন্যান্য সহযোগী ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও র্যালিতে যোগ দেন। হাতে ও মাথায় জাতীয় এবং দলীয় পতাকাসহ বিভিন্ন রঙের ক্যাপ পরে র্যালিতে অংশ নেন। র্যালির সামনে ছিল ব্যান্ড পার্টি। অনেকে ধানের শীষ দিয়ে সেজে র্যালিতে আসেন। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের আরও সতর্ক এবং সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে এখন। দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদের সময় আমরা নিরাপদ ছিলাম না। আমাদের সন্তানরা নিরাপদ ছিল না। আমাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। পুরো বাংলাদেশকে বর্বর বন্দিশালা বানানো হয়েছিল। গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন না থাকায় এমনটা হয়েছিল। তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্র এবং দেশের জনগণের সামনে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অপার সম্ভাবনা এবং সুযোগ এসেছে। ‘চব্বিশের আন্দোলনের কারণে আসা সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করা গেলে; জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারলে, ভবিষ্যতে আর কেউ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাবে না। দেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে না। আর কোনো রক্তাক্ত চব্বিশ আমাদের দেখতে হবে না। বিজয় মিছিল আয়োজন নিয়ে তারেক রহমান বলেন, পতিত ও পলাতক ফ্যাসিস্টের আমলে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। তারেক রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপিসহ বিরোধী দল এবং মতের নেতা-কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির এমন নেতাও রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে। এমনকি ৪ শতাধিক মামলাও আছে অনেকের বিরুদ্ধে। গুম-অপহরণের শিকার হয়েছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলের শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। শুধু চব্বিশের এক মাসে গণ অভ্যুত্থানে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিদের বন্দুকের নল থেকে মায়ের কোলে থাকা চার বছরের শিশুও রেহাই পায়নি। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টের কারণে আমাদের অনেক সাহসী সেনা কর্মকর্তার হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছে। আজকের (গতকাল) এই মিছিল অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোর পথে যাত্রা উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, তবে এ যাত্রা খুব সহজ নয়। ফ্যাসিবাদ উগ্রবাদ, চরমপন্থা যাতে আলোর পথে অন্ধকারের রেখা টেনে যেতে না পারে, এ ব্যাপারে গণতান্ত্রিক জনগণকে সদা সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তারেক রহমান। তিনি আরও বলেন, আমাদের ভাই-বোন সন্তান-স্বজনদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের অর্জিত ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে আর কখনো চব্বিশের মতো রক্ত দেখতে হবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আপনার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য, পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য একজন নাগরিক হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। বিএনপির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বিজয়ের শুরুতে স্বাধীনতা প্রিয়, গণতন্ত্র প্রিয়, দেশবাসীর উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, যিনি যেই দলেরই সদস্য কিংবা যে রাজনৈতিক দলেরই সদস্য হোন না কেন, আমাদের অবশ্যই সবার একটি কথা মনে রাখা দরকার। ফ্যাসিস্ট শাসনামলে আমরা কেউই নিরাপদ ছিলাম না। আমাদের সন্তানেরা কেউ নিরাপদ থাকতে পারেনি। আমাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আমাদের সব গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে গণতান্ত্রিক জনগণের জন্য সমগ্র বাংলাদেশটাকেই বরাবর বন্দিখানা, আয়নাঘর বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। সুতরাং দেশে যদি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন না থাকে তাহলে নারী কিংবা পুরুষ, সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু কেউই নিরাপদ নই। একমাত্র গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। সেজন্যই আসুন, দেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য, হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং চর্চা করি।
তিনি আরও বলেন, জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে, বিএনপি কী ধরনের সরকার এবং রাজনীতি পরিচালনা করবে তা দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ৩১ দফার মাধ্যমে একটি রূপরেখা জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছি। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সব গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। তবে দেশ এবং জনগণের কল্যাণে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি জনগণের সমর্থন এবং সহযোগিতা চায়। সব শেষে ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে বিএনপির উদ্যোগে রাজধানীসহ সারা দেশে বিজয় র্যালির কর্মসূচির সাফল্য কামনা করেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা।
র্যালি ঘিরে যানজট ও শোডাউন : বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টন, বিজয়নগর, পুরানা পল্টন ও শান্তিনগর এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। কর্মসূচি সফল করতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এর ফলে নয়াপল্টন থেকে বিজয়নগর, শান্তিনগর, পুরানা পল্টন মোড়ের আশপাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এসব এলাকায় যানবাহন প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলাচল করতে পারেনি। র্যালি উপলক্ষে নেতা-কর্মীরা শোডাউন করেন। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক, দক্ষিণের আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের সদস্যসচিব মোস্তফা জামান, দক্ষিণের সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিন জুয়েল, সদস্যসচিব সাজ্জাদুল মিরাজ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শ্রমিক দলের আহ্বায়ক মো. সুমন ভূইয়া, সদস্যসচিব বদরুল আলম সবুজ, মহানগর উত্তর শ্রমিক দলের সদস্যসচিব কামরুল জামান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন সরদার, মহানগর উত্তর বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক এ বি এম এ রাজ্জাক, এম কফিল উদ্দিন আহমেদ, হাজী মো. ইউসুফ, দারুসসালাম থানা বিএনপি আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক সাজুসহ বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী অংশ নেন।