যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনে বাণিজ্য হারাচ্ছে বাংলাদেশ। যুদ্ধ শুরুর পর গত তিন বছরে দেশ দুটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। রাশিয়ায় সবচেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি হয়েছে পেমেন্ট পরিশোধ নিয়ে। প্রথমদিকে ইউক্রেনে রপ্তানি ধারা অব্যাহত থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আশঙ্কাজনক হারে কমছে। যুদ্ধাবস্থা না কাটলে রুশ-ইউক্রেনে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক হিস্সা আরও কমতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিকেএমইএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন দুটিই বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য সম্ভাবনাময় বাজার ছিল। যুদ্ধের কারণে সেই সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয়, পেমেন্ট জটিলতার কারণে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
বিকেএমইএ জানিয়েছে, যুদ্ধের পর রাশিয়ার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে পেমেন্ট জটিলতা তৈরি হয়, যা দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করে। বিকেএমইএ প্রেসিডেন্ট জানান, গত এক বছরে শুধু নিট পোশাক ব্যবসায়ীদের ৬৫ লাখ মার্কিন ডলার পেমেন্ট আটকে গেছে রাশিয়ায়, যার মধ্যে তার নিজের প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। আটকে যাওয়া পেমেন্ট ছাড় করার জন্য সরকারি পর্যায়ে সহায়তা চেয়ে দুই-এক দিনের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিকেএমইএর পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ায় বাংলাদেশের বার্ষিক পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়েছিল। এর ওপর ভিত্তি করে দেশটিতে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বার্ষিক ১ বিলিয়ন ডলার উন্নীত করার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন পোশাক ব্যবসায়ীরা। একইভাবে ইউক্রেনেও তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ ছিল। পোশাক রপ্তানিকারকরা জানাচ্ছেন, আউটারওয়্যার, সোয়েটার, অ্যাকটিভওয়্যার, স্পোর্টসওয়্যার ছাড়াও নারী ও পুরুষের ওভারকোট, কারকোট, ট্রাউজার্স, জ্যাকেট, ব্ল্যাজার্স, নাইট শার্ট, ব্লাউজ, কার্ডিগান, পুলওভার এবং কটন, সিনথেটিক ও আর্টিফিশিয়াল ফেব্রিক্সে তৈরি পোশাকের সম্ভাবনাময় বাজার ছিল রুশ-ইউক্রেনে।
যেভাবে কমছে রপ্তানি আয় : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার। তার এক বছর আগে এটি ছিল ৬৬৫ মিলিয়ন ডলার। তবে যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম বছরেই রাশিয়ায় রপ্তানি আয় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি আয় কমে ৩৭২ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কম ছিল।
সর্বশেষ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আট মাসে রাশিয়ায় বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ২৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রায়।
আবার চলতি অর্থবছরের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আট মাসে ইউক্রেনে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রায়, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেকের কাছাকাছি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আট মাসে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ইউক্রেনেও বাংলাদেশের রপ্তানি কমছে আশঙ্কাজনক হারে।
পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধের পরপরই করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে অতিমারির প্রভাব কেটে যাওয়ার পর ইউরোপের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি স্বাভাবিক এবং কিছু দেশে আগের তুলনায় বেড়েছে। যুদ্ধরত দুই দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। সহসা যুদ্ধ না থামলে আর পেমেন্ট জটিলতা না কাটলে সম্ভাবনাময় বাজার দুটি হারানোর শঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের।