কথায় আছে ‘যে রাঁধতে পারে সে চুলও বাঁধতে পারে’। ঢাকাই চলচ্চিত্রে অনেক শিল্পী অভিনয়ে এসে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তাদের অনেকে আবার চলচ্চিত্র পরিচালনায় এসেও সমান মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। অভিনয় ও নির্মাণে এসে পেয়েছেন দর্শকপ্রিয়তা এবং জাতীয়সহ নানা সম্মাননা। এমন কয়েকজন সফল তারকা-নির্মাতার কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
খান আতাউর রহমান
১৯৫৭ সালে এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ দিয়ে অভিনয় শুরু খান আতাউর রহমানের। অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করে দর্শক-ভালোবাসা লাভ করেন তিনি। তার পরিচালিত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘সুজন সখী’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘হিসাব নিকাশ’সহ অসংখ্য ছবি নন্দিত হয়।
সুভাষ দত্ত
১৯৬০ সালে এহতেশামের ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ সুভাষ দত্তের। ১৯৬৩ সালে প্রথম নির্মাণ করেন ‘সুতরাং’ ছবিটি। এরপর ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘আবির্ভাব’, ‘বসুন্ধরা’, ‘সবুজ সাথী’, ‘ফুলশয্যা’, ‘আকাক্সক্ষা’, ‘নাজমা’, ‘আগমন’, ‘ডুমুরের ফুল’সহ অসংখ্য ছবি নির্মাণ করে নির্মাতা হিসেবে খ্যাতি ও সম্মাননা লাভ করেন তিনি।
আজিম
১৯৬০ সালে এহতেশামের ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আসেন আজিম। এরপর তার অভিনীত শতাধিক ব্যবসাসফল ছবি উপহার পায় দর্শক। সত্তর দশকে এই অভিনেতা চলচ্চিত্র পরিচালনায় আসেন। তার নির্মিত প্রথম ছবির শিরোনাম ‘টাকার খেলা’। তার পরিচালিত প্রতিনিধি, জীবন মরণ, বদলা, গাদ্দার, দেবর ভাবী ছবিগুলোও দর্শকপ্রিয়তা পায়।
আমজাদ হোসেন
আমজাদ হোসেন অভিনয়ে আসেন ১৯৬১ সালে ‘তোমার আমার’ ছবির মাধ্যমে। ষাট দশকে ‘বাল্যবন্ধু’ এরপর আরও কয়েকটি ছবি পরিচালনা করে প্রশংসিত হন। ১৯৭৭ সালে ‘নয়ন মনি’, ১৯৭৮ সালে তার নির্মিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এরপর সুন্দরী, কসাই, ভাত দে, দুই পয়সার আলতা, জন্ম থেকে জ্বলছিসহ আরও বেশ কটি ছবি দর্শকনন্দিত ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়।
রহমান
১৯৬০ সালে ‘হারানো দিন’ ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে এসে খ্যাতি পান। এরপর চান্দা, তালাশ ছবিতে তার অভিনয় কালজয়ী হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে আসেন। নির্মাণ করেন ‘দরশন’, ‘কঙ্গন’, ‘যাহা বাজে সেহনাই’ ‘নিকাহ’ ইত্যাদি। অভিনেতার মতো নির্মাতা হিসেবেও সফল হন তিনি।
রাজ্জাক
১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়ক হয়ে সাড়া জাগান। ১৯৭৭ সালে প্রথম নির্মাণ করেন ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিটি। এরপর ‘বদনাম’, ‘চাপাডাঙ্গার বউ’, সৎভাই, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সন্তান যখন শত্রু’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘অভিযান’, ‘মৌচোর’, ‘আমি বাঁচতে চাই’, ‘কোটি টাকার ফকির’সহ অনেক ছবি নির্মাণ করেন এবং নির্মাতা হিসেবেও সফল হন।
সোহেল রানা
মাসুদ পারভেজ নামে স্বাধীন দেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করেন সোহেল রানা। পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু ১৯৭৪ সালে ‘মাসুদ রানা’ ছবির মাধ্যমে। এতে নিজে অভিনয় করেন। ছবিটি অসাধারণ ব্যবসা করে ও অভিনেতা হিসেবে তিনি নন্দিত হন। এরপর তিনি পরিচালনা করেন প্রায় অর্ধডজন চলচ্চিত্র। সবই সফল ও পুরস্কৃত হয়।
আলমগীর
১৯৭৩ সালে ‘আমার জন্মভূমি’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন আলমগীর। অসংখ্য ছবিতে দক্ষ অভিনয় দিয়ে দর্শক ভালোবাসা কুড়ান। ১৯৮৫ সালে প্রথম নির্মাণ করেন ‘নিষ্পাপ’ ছবিটি। এরপর ‘নির্মম’, ‘বৌমা’, ‘মায়ের দোয়া’ ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিগুলো দিয়ে নির্মাতা হিসেবেও সফল হন। তার অভিনীত ও নির্মিত প্রতিটি ছবিই দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।
বুলবুল আহমেদ
সত্তর দশকে অভিনয়ে এসে জীবন নিয়ে জুয়া, ওয়াদা, জন্ম থেকে জ্বলছি, আরাধনা, সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা, দেবদাস, ছোট মা, সোহাগ, ঘর সংসার, বৌরাণীসহ অসংখ্য ছবির জনপ্রিয় এ নায়ক আশির দশকে নির্মাণ করেন ভালো মানুষ, মহানায়ক, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তসহ বেশ কিছু ছবি। তার অভিনীত ও নির্মিত সব ছবিই সফল হয় এবং নানা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
সুচন্দা
ষাটের দশকে সুভাষ দত্তের ‘কাগজের নৌকা’র মাধ্যমে অভিনয়ে আসা এ নায়িকার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হচ্ছে নয়নতারা, মনের মত বউ, জীবন থেকে নেয়া, কুঁচবরন কন্যা। আশির দশকে নির্মাণে এসে ‘তিন কন্যা’, ‘প্রেম প্রীতি’, ‘সবুজ কোট কালো চশমা’, ‘হাজার বছর ধরে’ ছবিগুলো নির্মাণ করে প্রশংসিত ও জাতীয় চলচ্চিত্র এবং বাচসাসসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হন।
শাবানা
ষাটের দশকে রত্না। এরপর এহতেশাম পরিচালিত ‘চকোরী’ ছবিতে শাবানা নামে অভিনয় করেন নব্বই দশক পর্যন্ত। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম নির্মাণে আসেন ‘মাটির ঘর’ ছবির মাধ্যমে। আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে নির্মাণ করেন ২৫টি ছবি। সবই হিট। অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাতা হিসেবেও সফল শাবানা। তার ছবিগুলো নানা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
সুজাতা
১৯৬৫ সালে সালাউদ্দীন পরিচালিত ‘রূপবান’ ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে এসে প্রথম ছবিতেই তারকা খ্যাতি পেয়ে যান সুজাতা। এরপর অবুঝ মন, অশ্রু দিয়ে লেখা, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, ছুটির ঘণ্টা, প্রতিনিধিসহ দেড় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি পরিচালনা করেন ‘অর্পণ’ শিরোনামের ছবিটি। এটি তুমুল ব্যবসা করে ও প্রশংসিত হয়।
ববিতা
১৯৬৮ সালে নূরুল হক বাচ্চুর সংসার ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে আসা ববিতার জনপ্রিয়তার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। ১৯৭৪ সালে কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। ববিতা ফুলশয্যা, আগমন, পোকামাকড়ের ঘরবসতিসহ বেশ কটি ছবি নির্মাণ করে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হন।
মৌসুমী
মৌসুমী ১৯৯৬ সালে ‘গরীবের রানী’ ছবি দিয়ে প্রযোজক হন। একই বছর সুখের ঘরে দুখের আগুন ও বউয়ের সম্মান প্রযোজনা করেন। এরপর আমি এতিম হতে চাই প্রযোজনা করেন। ২০০৩ সালে কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি দিয়ে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৫ সালে পরিচালনা করেন মেহের নিগার। ২০১৬ সালে শূন্য হৃদয় নামে একটি টেলিফিল্ম পরিচালনা করছেন।
জয়া আহসান
২০১৮ সালে মুক্তি পায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত মিসির আলি ধারাবাহিকের প্রথম উপন্যাস থেকে ‘দেবী’ ছবিটি। সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন অনম বিশ্বাস এবং প্রযোজনা করেন অভিনেত্রী জয়া আহসান তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সি-তে সিনেমা থেকে। এতে তিনি অভিনয় করেন এবং ছবিটি সফল হয়
তৌকীর আহমেদ
তৌকীর আহমেদ আশির দশকে অভিনয়ে আসেন। নাটক ও চলচ্চিত্র দুই মাধ্যমেই অভিনয় করেন। ২০০৪ সালে তিনি প্রথম চলচ্চিত্র জয়যাত্রা পরিচালনা করেন। এ ছাড়া ২০০৬ সালে চলচ্চিত্র রূপকথার গল্প। ২০০৭ সালে দারুচিনি দ্বীপ। অজ্ঞাতনামা (২০১৬), হালদা (২০১৭), ফাগুন হাওয়ায় (২০১৯) এবং ২০২০ স্ফুলিঙ্গ নির্মাণ করেন। সব কটি চলচ্চিত্রই জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।