দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রতিদিন এক ঘণ্টা, ধারাবাহিক সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি নাটক প্রচার হয়। বেশির ভাগ বড় মাপের তারকাসমৃদ্ধ এসব নাটকে নেই আগের সেই জৌলুস। অথচ শিল্পীরা পারিশ্রমিক বাড়িয়েই চলেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি টিভি চ্যানেলের দাবি- শিল্পীরা তাদের পারিশ্রমিক বাড়ালেও তাদের অভিনয়ে নেই কোনো প্রাণ। কারণ টিভি চ্যানেল বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এখন ইউটিউব চ্যানেলেও নাটক প্রচার শুরু হওয়ায় কোনো কোনো শিল্পী অতিরিক্ত পরিমাণে নাটকে কাজ করতে গিয়ে মনোযোগের অভাব ও তাড়াহুড়ার কারণে তারা অভিনয়ে মানের দিকে দৃষ্টি দিতে পারছেন না। বেশি নাটকে কাজ করে মোটা দাগে অর্থ উপার্জন কীভাবে করা যায় সেদিকেই ঝুঁকে পড়েছেন তারা। এতে প্রতিনিয়ত নিম্নমানের নাটক প্রচার হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থায়। চ্যানেলে ইন হাউস থেকে নাটক চলে এসেছে বিজ্ঞাপনী এজেন্সির কাছে। কয়েকটা এজেন্সি ধীরে ধীরে টিভি চ্যানেলের সব নাটক দক্ষতার সঙ্গে দখল করে নিয়েছে অল্প সময়ে। মানহীন নাটকের জন্য চ্যানেল দায়ী করছে নির্মাতাদের। আর নির্মাতারা দায়ী করছেন বাজেট স্বল্পতাকে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাদের আর্থিক অসংগতির জন্য বিজ্ঞাপনের বাজেট কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন। আর বিজ্ঞাপনদাতারা দায়ী করছেন চ্যানেলগুলোর দর্শক হারানোকে। বেশ কজন নির্মাতা বলেন, বর্তমানে একটি এক ঘণ্টার নাটকের জন্য টিভি চ্যানেল থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পাওয়া যায়। অথচ নির্মাণ ব্যয় থেকে শুরু করে সব শিল্পীর সম্মানি আগের চেয়ে বেড়ে কয়েকগুণে দাঁড়িয়েছে। খরচের বড় একটা অংশ যায় শিল্পী সম্মানি খাতে। আমাদের দেশে শিল্পী সম্মানির কোনো নির্ধারিত তালিকা নেই। ফলে যে যার মতো সম্মানি আদায় করে নিচ্ছেন। একটি নাটকের মূল বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি দিতে হয় শিল্পী সম্মানি বাবদ। এখন এক ঘণ্টার নাটকের গল্পের জন্য গল্পকারকে দেওয়া হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বা তারও কম। একজন ক্যামেরাম্যানকে দিতে হয় প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। সহকারী পরিচালক প্রতিদিন ৫০০/১০০০ বা সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকার বেশি পান না। লাইটের ক্ষেত্রে গড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাগে। ক্যামেরা ভাড়া ৩ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। একটি নাটক নির্মাণ করে লাভ হওয়া দূরের কথা, আসল টাকা ফিরে পাওয়াও কষ্টকর। শিল্পীদের সম্মানি বৃদ্ধির কারণে দেখা যায় নাটকের পুরো খরচের অর্ধেকই চলে যায় শিল্পী সম্মানিতে। বাকি অর্ধেক পুরো নাটকের সব খরচ। এদিকে তারকা শিল্পী ছাড়া নাটক না বানালে স্পন্সরে ঝামেলা হবে, চ্যানেলে নাটক বিক্রিও সমস্যা হবে। বাজেট স্বল্পতার কারণে বেশির ভাগ নাটকে থাকে না কোনো পরিবার। শুধু নায়ক-নায়িকার ওপর ভর করেই নির্মিত হচ্ছে নাটক। ফলে পরিচালকরা দুজন তারকা শিল্পীকে নিয়ে কাজ করেন। বাজেট কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ নাটকের দৃশ্যধারণ হয় ঢাকা; বড়জোর পুবাইল-হোতাপাড়ার আশপাশে। অনেক পরিচালক আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখন নাটকের সব টাকা নিয়ে যাচ্ছে প্রধান দুই চরিত্র। যে কারণে পরিবার ছাড়াই নির্মাণ হচ্ছে নাটক।’ প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত বলেন, ‘এখনকার বেশির ভাগ নাটক ভাঁড়ামিপূর্ণ ও দুই-তিনজন শিল্পীনির্ভর। আর গল্প ছাড়াই নাটক হচ্ছে।’ অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এখন নাটক নির্মাণ করছি না। এর কারণ দুটো চরিত্র যদি সব টাকা নিয়ে যায় তাহলে কীভাবে বাকি শিল্পীদের টাকা দেব?’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক বলেন, আমাদের আসলে কিছু করার নেই। কারণ টিভি থেকে বলে দেওয়া হয়, কাকে কাকে নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যখন সেই শিল্পীর কাছে শিডিউলের জন্য যাই, তখন তিনি নাটকের অর্ধেক টাকা দাবি করেন।
এখন একটা নাটকে যে বাজেট থাকে, তার ৭০ ভাগ টাকা নিয়ে নেন নায়ক ও নায়িকা। আমরা কীভাবে পরিবার নিয়ে সুন্দর একটি নাটক নির্মাণ করব? ফলে প্রায় নাটকের গল্প ও নির্মাণ একই রকম হয়ে যাচ্ছে। বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান তারেক আখন্দ বলেন, আমরা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাছাই করা, মানসম্মত নাটক প্রচার করে থাকি। যদিও বাজেটের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে এ কথা ঠিক, ভালো বাজেট দিলেই ভালো নাটক হবে, এমন কোনো কথা নেই। স্বল্প বাজেটের কারণে নাটকের মান হারাচ্ছে, দর্শক নাটক দেখছে না- এ কথার সঙ্গে আমরা একমত নই। কারণ পাঁচ বছর আগে একটি একক নাটক যে টাকা দিয়ে কিনতাম, এখন তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে এক ঘণ্টার নাটক কিনছি। আর বাংলাভিশন নাটকের মান রক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত। যে কারণে আমরা চেষ্টা করি বিশেষ দিবসের জন্য ভালো বাজেট দিয়ে ভালো নাটক নির্মাণের।’
আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান বলেন, ‘একটি ভালো নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু করা দরকার, তা-ই করার চেষ্টা করি সব সময়।’ নাট্যনির্মাতা এস এ হক অলীক বলেন, অতিমাত্রায় টিভি চ্যানেল, অতিরিক্ত নাটক নির্মাণ, নাটকের বাজেট হ্রাসসহ অনেক কারণে নির্মাণ আর অভিনয়, দুইয়ের মানই কমেছে।
বর্তমানে নাটকের শীর্ষ তারকাদের মধ্যে সর্বাধিক পারিশ্রমিক নেন অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব। দুই বছর আগে নাটকপ্রতি দুই-তিন লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিলেও বর্তমানে তিনি একটি নাটক থেকে পারিশ্রমিক নেন সর্বনিম্ন ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। শর্ত থাকে, তিন দিনে শুটিং শেষ করতে হবে। তিন দিনের বেশি শুটিং হলে প্রতিদিন শুটিংয়ের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করেছেন দেড় লাখ টাকা। কোনো নাটকের শুটিং ১০ দিন হলে সে ক্ষেত্রে নাটকপ্রতি পারিশ্রমিক দাঁড়ায় ১০-১৫ লাখ টাকা। অপূর্বর সঙ্গে কাজ করা পরিচালক ও প্রযোজকরা এ তথ্য দেন। মেহজাবীন প্রতি নাটকে নেন দেড় থেকে ২ লাখ এবং তানজিন তিশা ২ লাখ। বর্তমানে নাটকপ্রতি ৩ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন মোশাররফ করিম, নিলয় আলমগীর, মুশফিক আর ফারহান। নিশো নেন তিন থেকে চার লাখ টাকা। আড়াই লাখ টাকা পারিশ্রমিকের তালিকায় রয়েছেন তৌসিফ মাহবুব, ফারহান আহমেদ জোভানসহ কয়েকজন। অভিনেত্রী সাফা কবির নাটকপ্রতি পারিশ্রমিক নেন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। অভিনেত্রী জান্নাতুল হিমি বর্তমানে নাটকপ্রতি ৫০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক নেন। অভিনেতা খায়রুল বাসার নাটকপ্রতি পারিশ্রমিক নেন ১ লাখ টাকা। ইয়াশ রোহান নেন ১ লাখ টাকা। সামিরা খান মাহি প্রতি নাটকের জন্য ৪০-৫০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক নেন। অভিনেত্রী তটিনী প্রতি নাটকের জন্য নেন ৮০ হাজার টাকা। অভিনেত্রী নাজনীন নিহা প্রতি নাটকে নেন ৭০ হাজার টাকা। তানিয়া বৃষ্টির পারিশ্রমিক ৭০ হাজার টাকা। অর্ষা নাটকপ্রতি নেন ৬০ হাজার টাকা।
বেশ কজন নির্মাতা বলেন, তারকারা যদি পারিশ্রমিক ৫০ হাজারের মতো কমান, তাহলে এমনিতেই অন্যান্য খরচও অন্তত ২ লাখ টাকা কমানো যাবে। তাহলে বাড়তি স্পন্সর ছাড়াই নাটক মুক্তি দিয়ে টাকা ওঠানো যাবে।