জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে এসে টানা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন বাংলাদেশ। একের পর এক বৈঠকে অংশ নিয়ে তিনি তুলে ধরছেন দেশের সাংবিধানিক সংস্কারের রূপরেখা, আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি, রোহিঙ্গা সংকট এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা।
মঙ্গলবার রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংবর্ধনায় যোগ দেওয়ার পর বুধবারই তিনি বৈঠক করেছেন চার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে। পাকিস্তান, ইতালি, ফিনল্যান্ড ও কসোভোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও ড. ইউনূস মতবিনিময় করেছেন শীর্ষ মার্কিন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
জুলাই সনদ শিগগিরই, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন : প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকগুলোতে নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো শিগগিরই সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মূল বিষয়সমূহ নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ সই করবে। এর লক্ষ্য স্বৈরশাসকের উত্থান ঠেকানো এবং টেকসই গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন।
তিনি জানান, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৫ বছর পর ভোটাররা প্রকৃত নির্বাচনের সুযোগ পাবে। এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বনেতাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন ড. ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বৈঠকগুলো বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানোর বিষয়েও নেতারা একমত হয়েছেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক : ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠকে উঠে আসে নির্বাচন, সংস্কার ও আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রসঙ্গ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানকে সমবেদনা জানান ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায় চলছে, অচিরেই সই হবে ‘জুলাই সনদ’। এ প্রক্রিয়া দেশকে অর্থবহ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে নিয়ে যাবে। শাহবাজ শরিফ আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের বিকল্প পথ খুঁজতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও আলোচনা হয়।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে বৈঠক : ড. ইউনূসের সঙ্গে মেলোনির বৈঠকে উঠে আসে অভিবাসন ও মানব পাচার ইস্যু। মেলোনি প্রস্তাব করেন, ‘ইতালি-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম’ গঠন করা হবে, যাতে ইতালিয়ান বিনিয়োগ আরও সম্প্রসারিত হয়। ড. ইউনূস প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের হলেও বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা এখনো অপ্রকাশিত। বৈঠকে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা ও মানব পাচার রোধে সমন্বিত উদ্যোগের ওপর জোর দেন দুই নেতা। মেলোনি বলেন, ভূমধ্যসাগরে মানব পাচারের কারণে শত শত প্রাণহানি ঘটছে। এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। ড. ইউনূস জানান, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করেছে এবং নিরাপদ অভিবাসনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও গঠনমূলক আলোচনা হয়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ইতালি বাংলাদেশের অবাধ নির্বাচনের জন্য সমর্থন দেবে।
ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের সঙ্গে বৈঠক : ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চলছে। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার জন্যও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই বাংলাদেশ সার্ক ও আসিয়ানের মধ্যে প্রধান সেতুবন্ধন হোক।’ আলোচনায় উঠে আসে রোহিঙ্গা সংকট, জাতিসংঘ সংস্কার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও জলবিদ্যুৎ সহযোগিতা। ড. ইউনূস স্পষ্ট করে বলেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। জনগণ দীর্ঘদিন ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত, এখন তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
কসোভোর প্রেসিডেন্টে ভিওসা ওসমানির সঙ্গে বৈঠক : কসোভোর প্রেসিডেন্ট ভিওসা ওসমানির সঙ্গে ড. ইউনুসের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, দুই নেতা ভবিষ্যতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মার্কিন ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান : ‘অগ্রসর সংস্কার, স্থিতিস্থাপকতা ও প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ এক্সিকিউটিভ বিজনেস রাউন্ড টেবিলে যোগ দেন ড. ইউনূস। এতে মেটলাইফ, শেভরন, এক্সেলেরেটসহ শীর্ষ মার্কিন কোম্পানির প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে সংস্কারপ্রক্রিয়া বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করছে। এখনই বিনিয়োগের সেরা সময়।’ তাঁর সঙ্গে ছিলেন সফরসঙ্গী পাঁচ রাজনৈতিক নেতা। বৈঠকে মার্কিন উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
ক্লাব ডি মাদ্রিদের আমন্ত্রণ : স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ক্লাব ডি মাদ্রিদের সভাপতি দানিলো তুর্ক বৈঠকে ড. ইউনূসকে সংগঠনের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন দুনিয়াকে বিস্মিত করেছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তর বিষয়ে আপনার মতামত আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়ন করব।’
তুর্ক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বৈশ্বিক প্রভাব নিয়েও প্রশংসা করেন এবং বলেন, ইউনূসের অভিজ্ঞতা বিশ্বনেতাদের কাছে মূল্যবান হবে।
ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ : মঙ্গলবার রাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেওয়া সংবর্ধনায় যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় তিনি ট্রাম্পকে সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসার আমন্ত্রণ জানান।