ফিডার খাওয়া বয়স থেকেই দাদির কাছে রূপকথা শোনার অভ্যাস নোহাদের। গল্প শুনতে শুনতে তার মনের পাখিটাও রূপকথার জগতে বিচরণ করে। আর ঘুমিয়ে পড়ে। তুষার শুভ্রের মতো সুন্দরী রাজকন্যা হয়ে উঠে, পরীদের হাত ধরে, মেঘের উড্ডয়নের ওপর বসে, আকাশে হেঁটে চলে পরীর দেশে। রূপকথার জগতে, দেখতে পায় সুন্দর, রঙিন পরীরা বড় চকচকে ডানা নিয়ে বাতাসে উড়ছে। নোহাদও তাদের সাথে খেলে।
সম্ভবত এটা দাদির জাদু, যা নোহাদকে ঘুম আনিয়ে দেয়, খুব কার্যকর ম্যাজিক। তাই ধীরে ধীরে দিনের বেলায়ও পরীর জগতে যাত্রা শুরু করল। নোহাদের ছোট ছোট ইচ্ছা দাদি পূরণ করেন। সে যা চায় তা সহজেই পেয়ে যায়। প্রায়ই দাদিকে জিজ্ঞাসা করে, আমি যদি কিছু চাই তবে পরী কি আমাকে দেবে?
দাদিও মনের আনন্দে বললেন, হ্যাঁ।
এক দিন নোহাদ দাদিকে বলল, আমি পরীর হাতের একটি আপেল চাইব।
দাদি বললেন, দুই দিন পর পরী এনে দেবে।
ঠিক দুই দিন পর রাতে নোহাদ মাথার কাছে একটি সবুজ আপেল পেল।
সেই অদেখা পরী নোহাদের বন্ধু হয়ে উঠেছে। কিন্তু যখনই তাকে দিনের বেলা কিছু চাইতে হয়, পরী খাবার এনে দেয় দেরি করে। এক দিন অথবা দুই দিন পর রাতে নোহাদ খেতে পায়। অন্যান্য জিনিস নোহাদ রাতে চায়। বড় কিছু চাইলে পরী দুই-তিন দিন সময় নেয়। কারণ জিজ্ঞেস করতেই দাদি বললেন, এটার কারণ হলো পরী সবসময় তোমার জন্য ভালো জিনিস আনতে অনেক দূরে যায়।
এমন গল্প শুনেই বড় হচ্ছে নোহাদ। বাড়িতে তার একটি ছোট ভাই আছে। তার খালার বাড়িতে একটি ছোট ভাইও এসেছে।
সে যখন তার ভাইকে দেখতে হাসপাতালে গেল, সেখানে অনেক ছোট বাচ্চাকে দেখল। নোহাদ বলল, আমি হাসপাতাল থেকে একটি শিশুপুতুল নেব, তার সঙ্গে সারা দিন খেলব। পরীকে বলো এনে দেবে।
দাদি বিরক্ত গলায় বললেন, এখন তুমি বড় হয়েছো, বড় ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট জিনিসের জন্য পরীদের বিরক্ত করে না। পরীদেরও অনেক ছোট বাচ্চাদের দেখতে হয়। কারণ তোমার ছোট ভাইয়ের মতো ছোট বাচ্চারা তাদের নিজের কাজ করতে পারে না। নোহাদ আগের চেয়ে বুদ্ধিমতী হয়ে উঠছে।
কিন্তু সে এখনো পরীর বন্ধু। এখন দাদি তাকে আরেকটা খেলা শিখিয়ে দিলেন। দাদি বললেন, চোখ বন্ধ করে বসে থাকো, আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলো না। আমি যা-ই বলি না কেন, মন দিয়ে শোনো। চোখ খুলেই আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে।
ঘরে পর্দা ঢেকে দুজনেই দাদির নাতনি আলথি-পালথির সাথে বসা। দাদি যা যা বললেন আর নোহাদ শুনে গেল। প্রায় দশ-পনেরো মিনিট পর, দাদি আস্তে আস্তে নোহাদের চোখের ওপর হাত রাখলেন। ধীরে ধীরে চোখ খুলতে বললেন। তারপর শুরু হলো দাদির প্রশ্নের ধারা, ‘কী দেখেছো, কী করছো, কী শুনেছো?’ ঠিক এভাবেই নোহাদের মনের পাখি মাঝে মাঝে পরী হয়। লোকজন, কখনো পাখি, কখনো বাগানে বেড়ানো...।
বড় ক্লাসে এসে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। দাদির সাথে খেলার সময় নেই। দাদিও অনেক বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তারপরও দাদি নোহাদকে বললেন, যখনই কোনো সমস্যা হয় বা কোনো প্রশ্নের সমাধান হচ্ছে না, তখন চোখ বন্ধ করে বসে থাকো। তোমার পরী বন্ধু আস্তে আস্তে উত্তরটা বলবে।
এক দিন দাদি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। মা বললেন, দাদিও পরী হয়ে গেছে, স্বপ্নে দেখবে।
নোহাদ খুব একা বোধ করে, কিন্তু এত দিনে সে বড় এবং আরও বুদ্ধিমতী হয়েছে।
এক দিন এক ব্যায়ামের শিক্ষক স্কুলে ব্যায়াম শেখালেন। খেলাধুলায় নোহাদের দাদির কাছ থেকে শেখা জিনিসগুলো মনে পড়ে গেল। মনের পাখি উড়ে যায় যে কোনো জায়গায়। পাখিটা অনেক উড়ে যায় এখানে-ওখানে। কখনো সমস্যা সমাধানের জন্য পরী দাদিকে খোঁজ করে। কখনো রাতে ঘুমানোর সময় রূপকথার গল্প শুনতে পরী দাদিকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়। পরী দাদি আর আসে না। নোহাদও অভিমান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেবল মনে হয় তার এই অভিমানী দৃশ্য দেখে পরী দাদি দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।