‘বেশির ভাগ দর্শকের মানসিকতা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, শাকিবের সিনেমা বেশি বাজেটের, তাই এতে নানা ধরনের মাসালা থাকে। অতএব ঈদে শাকিবের সিনেমা দেখতেই হবে। এতে অন্য নায়কের সিনেমা ভালো মানের হলেও তারা তা দেখার আগ্রহ দেখায় না। ফলস্বরূপ অন্য নায়কের সিনেমা, এর প্রযোজক এবং প্রদর্শকরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে হবে।’-এ উদ্বেগ সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হল মালিকদের। এ প্রসঙ্গে লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা খালেক এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাসের কাছে জানতে চাইলে উভয়ের অভিন্ন মত এমন- ‘এ অবস্থার উত্তরণ তখনই সম্ভব যখন বছরের অন্তত একটি ঈদে শাকিবের নতুন সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ রাখা যায়। কারণ বছরের যেকোনো সময় শাকিবের সিনেমা মুক্তি পাবে তখনই তা চলবে দর্শকের ভ্রান্ত মানসিকতার কারণে। ঈদে যেহেতু সব প্রযোজক সিনেমা মুক্তি দিতে চান তাই শাকিববিহীন একটি ঈদে অন্য নির্মাতা ও নায়কদের সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শক তা দেখবেই। এতে তাদের শাকিবের সিনেমা নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙবে, তারা বাস্তবতা বুঝতে পারবে। ফলে অন্য নায়ক সৃষ্টি হবে, সিনেমা হল মালিক এবং শাকিববিহীন সিনেমার প্রযোজকরা বাঁচবেন।’ প্রদর্শকরা বলেন, দুই ঈদে শাকিবের সিনেমা মুক্তি পেলে বড়োজোর তা তিন মাস চলে। এরপর বছরের বাকি ৯ মাস সিনেমা হল মালিকরা সিনেমাশূন্যতায় পড়েন। মানে চরম লোকসান গোনেন। তাই বছরের একটি ঈদ অন্তত শাকিববিহীন চায় সব প্রদর্শক।
এদিকে এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া ছয়টি সিনেমার মধ্যে শাকিবের ‘তাণ্ডব’ সিনেমাটি শুধু সিনেপ্লেক্সগুলোতে আশানুরূপ ব্যবসা করছে, কিন্তু সিনেমা হলে টিকিট বিক্রি ক্রমেই কমছে বলে জানান প্রদর্শকরা। তারা বলছেন, প্রিয়তমা, তুফান আর বরবাদ দেখার পর তাণ্ডবে রায়হান রাফির মেকিং সন্তুষ্ট করতে পারেনি দর্শকদের। তাই তারা ক্রমেই হতাশ হয়ে তাণ্ডববিমুখ হচ্ছেন। প্রদর্শকরা জানান, যেসব সিনেমা হল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেখানেও তাণ্ডবের তাণ্ডব কমে যাচ্ছে।
এবারের ঈদে সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ছয়টি সিনেমা। এগুলো হলো- ‘তাণ্ডব’, ‘ইনসাফ’, ‘নীলচক্র’, ‘টগর’, ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’ ও ‘উৎসব’। এর মধ্যে শাকিব খান অভিনীত ‘তাণ্ডব’ সিনেমা ১৩২টি, আরিফিন শুভ ও মন্দিরা চক্রবর্তী অভিনীত ‘নীলচক্র’ সিনেমা ছয়টি মাল্টিপ্লেক্সে, সঞ্জয় সমাদ্দার পরিচালিত ‘ইনসাফ’ ১৫টি হলে মুক্তি পেয়েছে। এতে অভিনয় করেছেন- তাসনিয়া ফারিণ, মোশাররফ করিম ও শরিফুল রাজ। সাত সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়া আদর আজাদ ও পূজা চেরী অভিনীত ‘টগর’ পরিচালনা করেছেন আলোক হাসান। আজমেরী হক বাঁধন, পূজা অভিনীত ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’ সিনেমাটি মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পেয়েছে। এটি পরিচালনা করেছেন সানী সানোয়ার। নির্মাতা তানিম নূর হাজির হয়েছেন ‘উৎসব’ শীর্ষক সিনেমা নিয়ে। দেশের সাত মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পেয়েছে জাহিদ হাসান, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, অপি করিম, সাদিয়া আয়মান অভিনীত এ সিনেমাটি। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত ভালো চলছে ঈদের ছয়টি বাংলা সিনেমা। লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা খালেক বলেন, ঈদের সিনেমা যেহেতু শাকিব খানমুখী হয়ে পড়ে তাই সেটি এখনো দর্শক ধরে রেখেছে। অন্যদিকে ‘ইনসাফ’ কোনোভাবে চলছে।
এদিকে বেশ কিছু সিনেমা হল মালিক তাদের সিনেমা হল ও নিজেদের নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এবারের ঈদে শাকিবের তাণ্ডব প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শরিফুল রাজের ইনসাফেরও চিত্র একই বলা যায়। সেই তুলনায় ‘উৎসব’, ‘এশা মার্ডার’, ‘টগর’, ‘নীলচক্র’ সিনেমাগুলো নিয়ে তেমন বড় ধরনের প্রত্যাশা না থাকলেও এগুলো মোটামুটি সন্তোষজনক ব্যবসা করে যাচ্ছে। সিনেমা হল মালিকদের বেশির ভাগেরই মন্তব্য- আসলে ঈদে দর্শকরা ভালোমন্দ যাচাই না করে অন্ধের মতো শাকিবের সিনেমার পেছনে ছুটতে গিয়ে অন্য নায়ক ও প্রযোজকদের ক্ষতি করছে। এ কারণে সিনেমা হল মালিকরাও লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছেন। দুঃখজনক বিষয় হলো- এমন ফিল্মি পলিটিক্সের কারণে অন্য নায়করা যেমন ভালো কাজ করেও প্রতিষ্ঠা পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন তেমনি মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ করেও শুধু শাকিবকে না নেওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট প্রযোজকরা লোকসানের কবলে পড়ে নির্মাণ থেকে দূরে সরছেন। এতে শুধু সিনেমা হল, নির্মাতা ও অন্য শিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ছে। তাই সিনেমা হল মালিকদের দাবি- বছরের একটি ঈদ হলেও শাকিববিহীন হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বেশ কিছু সিনেমা হল মালিক বলছেন, ঈদে দর্শক বিনোদন পেতে এমনিতেই শাকিবের সিনেমা দেখে থাকে। কিন্তু ঈদ ছাড়া যে তার সিনেমা ফ্লপ হয় তার সাম্প্রতিক নজির হলো অনন্য মামুন পরিচালিত ও শাকিব অভিনীত ‘দরদ’ সিনেমাটি। এসব সিনেমা হল মালিকের দাবি হলো- ঈদে যে শাকিবের সিনেমার চেয়েও অন্য সিনেমা ভালো ব্যবসা করে তার প্রমাণ হলো পরান ও হাওয়া সিনেমা দুটি। এছাড়া বর্তমান সময়ের দর্শকপ্রিয় অভিনেতা আদর আজাদের ‘লিপিস্টিক’, ‘লোকাল’, ‘যাও পাখি বলো তারে’ সিনেমাগুলোও অতীতে দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছে। এই ঈদে আদর আজাদ ও পূজার টগর ছবিটি সিনেমা হলগুলোতে সন্তোষজনক ব্যবসা করছে বলে হল মালিকরা জানান। আগামী সপ্তাহে এ ছবির হল সংখ্যা বাড়বে বলে জানা গেছে। একইভাবে শরিফুল রাজের পরান, হাওয়া, দেয়ালের দেশ, ওমর সিনেমাগুলোর দর্শকপ্রিয়তার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।