প্রতিনিয়ত নাটকের ভাষা বিকৃতি ঘটছে। নাটক এখন হয়ে গেছে সস্তা বিনোদনের মাধ্যম। সামাজিক দায়বদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে ‘ভিউ’ নামক শব্দ। কারণ, যত ভিউ, তত টাকা। তাই স্বাভাবিকভাবে ভিউকে টার্গেট করেই এ সময়ে নির্মিত হচ্ছে নাটক। ভিউ বাড়াতে দেওয়া হচ্ছে নাটকগুলোর অদ্ভুত, অশ্লীল, চটকদার ও কুরুচিপূর্ণ নাম। যা আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশ্বে অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে তুলে ধরছে। আর ভিউ যখন লক্ষ্য হয় তখন নাটক হয়ে যায় ‘কনটেন্ট’। বেশি ভিউয়ের আশায় প্রযোজক, নির্মাতা থেকে শুরু করে শিল্পীরাও ভার্চুয়াল লড়াইয়ে শামিল হন। ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে দিন দিন বাংলা নাটকের ঐতিহ্য বিলীনের দিকে। ফলাফল শিল্পীরা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছেন। একপক্ষ শিল্পকে পণ্য বানিয়ে পকেট ভারী করছে, নীতিনির্ধারকদের অনীহা আর সিন্ডিকেটই নয়, শিল্পের দায় থেকে বহু দূরে এখন নাটক। খোদ নাটকের শিল্পীরাই এসব কথা বলেছেন। জনপ্রিয় অভিনেতা জিতু আহসান এ বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নাটক এখন সস্তা হয়ে গেছে। চাইলে যে কেউ নাটক বানিয়ে ফেলছেন। গল্প, নামকরণ, সংলাপের মাধুর্য, উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব নেই। একটি গোষ্ঠী তো চিত্রনাট্য ছাড়াই নাটক নির্মাণে অভ্যস্ত। তাদের কাছে এটি নিষ্প্রয়োজন। চিত্রনাট্য ছাড়া অভিনয় নাটকের মান ক্ষুণ্ন করছে। চতুর দর্শক সেটি ধরে ফেলছেন।’ এ সময়ের অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তি মনে করেন ভিউকে টার্গেট করে যা নির্মিত হচ্ছে এগুলো নাটক নয়, একেকটা কনটেন্ট। কার কনটেন্ট কত ভিউ হলো, কত টাকা এলো সেই হিসাব করে এখন। নাটকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা ও মান কখনো এক হতে পারে না। বাংলাদেশি নাটকের নিজস্ব স্বকীয়তা আছে।
অভিনেতা আবুল হায়াত বললেন, ‘এখন নাটকের নাম শুনলেই মোটামুটি সব বোঝা যায়। আমরা এখন ভাঁড়ামি গেলাতে চাইছি। জানি না কীভাবে বেরিয়ে আসা যাবে এখান থেকে। এখানে টেলিভিশন চ্যানেলের দায় অনেক।’ এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, ‘মানুষের রুচিকে নষ্ট করছি আমরা। যে রকম দেখানো হচ্ছে, দর্শকের রুচি সেভাবেই গড়ে উঠছে। কেমন অশ্লীল কথাবার্তা! কেমন রংঢং! এগুলো কোন সমাজের চিত্র? এগুলো কি বাঙালি সমাজ? এগুলো কি আমাদের ঐতিহ্য? আমাদের সংস্কৃতি? জানি না। আমি এগুলো দেখে বিরক্ত হই।’ নাট্যজন মামুনুর রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের দুঃখ, টেলিভিশন নাটক তো গেল, এখন ইউটিউব আরও জঘন্য। ভিউ বাড়াতে নাটকের নামে কনটেন্ট নির্মাণের যুদ্ধে নেমেছেন সবাই। ভিউ যেন এখন খুব দামি কিছু হয়ে গেছে।’
অন্যদিকে অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, ‘আমার একটা দায় আছে। দায় হচ্ছে- আমার একটা নাটক দর্শক দেখবেন, কিন্তু আমার সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, উলঙ্গ হয়ে নয়। কারণ, আমি তো আসলে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাই।’ বর্তমান অভিনয়শিল্পীরা নাটককে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। সেখানে অনেকেই সৃজনশীলতার কথা না ভেবে নিজের পকেট ভারী করছেন। নেই মেধার পেছনে বিনিয়োগ, শিল্পী-কুশলীদের মধ্যে নেই আদব-কায়দা। প্রায়ই ফোনে জাহিদ হাসানকে শুনতে হয়- ‘বস, একদিন লাগবে।’ কিছুটা মন খারাপ করে এ অভিনেতা বলেন, ‘বিশৃঙ্খলা ও দায়িত্বহীন বিষয়গুলো দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। পরিচালক বলছেন, ‘জাহিদ, এটা গল্প...আপনি এর ওপর দুই মিনিট অভিনয় করবেন।’ নিজেকেই ডায়ালগ বানিয়ে দিতে হচ্ছে। আবার তরুণেরা কিছু না শিখেই অভিনেতা হচ্ছেন। এভাবে শিল্পচর্চা করা নাটককে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে।’
সেই বিটিভির সময় থেকে প্যাকেজ ধারাবাহিক আমলে ভালো গল্পের নাটকের সুন্দর নাম দর্শকের মনে দাগ কাটত। দর্শক এসব নাম দেখে নাটক দেখায় উৎসাহ পেতেন। প্রান্তিক দর্শকের কাছে সে সময় বাংলা নাটক ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এরপর স্যাটেলাইটের কল্যাণে দর্শকরাও ভিন্ন স্বাদের নাটকের সঙ্গে পরিচিত হন। তবে এ মাধ্যমটির স্থায়িত্বও বেশি বছর হয়নি। নাটকের প্রচারস্থান দখল করে নিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। অথচ এ সময় একটি নাটকের মান নির্ণয় করা হয় ইউটিউব চ্যানেলে কত ভিউ হলো তার ওপর। মানের দিক বিবেচনা না করে, ভিউর ওপর সেটার দর্শকপ্রিয়তা বিচার করা হচ্ছে। নির্মাতা-শিল্পীরাও ভিউর পেছনে ছুটছেন। ফলে বস্তাপচা সস্তা নাটক নির্মিত হচ্ছে অধিক লাভের আশায়, যেটা নাটক ইন্ডাস্ট্রির জন্য এখন অশনিসংকেত।