নিম্নমানের কয়লা সরবরাহের কারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে বারবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুই নম্বর ইউনিট এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্রের এক নম্বর ইউনিট কোনো রকমে চালু থাকলেও উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকে। কেন্দ্রটির অভ্যন্তরে গত মার্চ মাসে মাটি মেশানো কয়লা সরবরাহ নিয়ে যে লংকাকাণ্ড শুরু হয়েছিল, সেই থেকে পরিস্থিতির উন্নতি আর হয়নি। একের পর এক চালানের কয়লায় লেগে থাকে নানা সমস্যা।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) থেকে গতকাল শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত কেন্দ্রে খালাস করা ৬৩ হাজার ৩০০ টন কয়লাতেও একই রকমের ঘটনার অবতারণা ঘটে বলে জানা গেছে। লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী লিলাফুজি নামের জাহাজটি ইন্দোনেশিয়া থেকে ওই পরিমাণ কয়লা নিয়ে আসে। খালাসের আগে জাহাজভর্তি কয়লার উপরিভাগে ঠিকই ভালো প্রত্যক্ষ করা গেছে।
কিন্তু গত বুধবার মধ্যরাতের দিকে জাহাজ থেকে ৩৪ হাজার টন কয়লা খালাসের পর থেকে নিম্নমানের কয়লার চিত্র ফুটে উঠতে দেখেন শ্রমিকরা। দেখা গেছে, দুই ইঞ্চি বা ৫০ মিটার সাইজের কয়লা যেখানে সরবরাহ করার কথা, সেখানে রয়েছে বিশাল সাইজের পাথরের খণ্ড এবং মাটি মেশানো গুঁড়ি। জাহাজ থেকে সব জাতীয় কয়লার কারণে খালাসের কাজেও বারবার বিঘ্ন ঘটে। সেই সঙ্গে মানহীন কয়লায় কেন্দ্রের যন্ত্রপাতিও মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে তিন শিফটের পালাক্রমে কাজে রয়েছেন ১২০ জন শ্রমিক। শ্রমিকদের বেশির ভাগকেই জাহাজ থেকে কয়লা খালাসের সময় পাথরের বড় খণ্ড, মাটি মেশানোসহ ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে সময় দিতে হয়। কয়লা খালাসের সময় নিম্নমানের কয়লার বিষয়টি নিয়ে শ্রমিকরা বারবার প্রতিবাদ করে এক প্রকার হয়রান হয়ে পড়েছেন। আবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে শ্রমিকরা পড়ছেন কর্তৃপক্ষের রোষানলে। নিম্নমানের কয়লা সরবরাহের বিষয়টি যেকোনোভাবেই ধামাচাপা দিতে চায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের লোকজন।
কিন্তু শ্রমিকদের তরফে এটা বারবার ফাঁস হওয়ার সন্দেহে কেন্দ্রের কর্মরত শ্রমিকদের শাসিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নেওয়া হয় কেন্দ্রে কয়লা খালাসের সময় নািশ্ছদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থাও। মানহীন কয়লার কোনো তথ্য যাতে বাইরে প্রচার না হয় সে জন্য কেন্দ্রে কর্মরত শ্রমিকদের এক প্রকার ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। লিলাফুজি জাহাজ থেকে পাথরখণ্ড এবং মাটি ও বালি মেশানো নিম্নমানের কয়লা খালাসের বিষয়টি সঠিক কি না জানতে চাইলে তিনি বারবার কেন্দ্র থেকে এসব তথ্য গণমাধ্যমকর্মীদের সরবরাহকারী ব্যক্তির নাম জানতে চান।
তিনি জানান, ‘জাহাজভর্তি কয়লার মান দেখভাল করার জন্য আমাদের একটি আলাদা কমিটি রয়েছে। কমিটির সদস্যরা আমার কাছে এ রকম কোনো কিছু জানাননি।’ তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিটের উৎপাদন গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রধান প্রকৌশলী।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে স্থানীয়দেরও কোনো কিছু জানা নেই জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন। একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁকেও কোনো বিষয় নিয়ে কেন্দ্রটির সমস্যা সমাধানেও শেয়ার করা হয় না বলেও জানান তিনি।
ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীর লোকজনের সহায় সম্পদ অধিগ্রহণ করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক অনিয়ম আর লুটপাটের ঘটনায় আমরা এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন। এখন পর্যন্ত পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের ঘাপটি মেরে থাকা কিছু লোকজনের কবলে পড়ে দেশের বড় মাপের একটি সম্পদ নীরবে নিভে যাচ্ছে।’ তিনি কেন্দ্রটির অভ্যন্তরে বিশেষ করে কয়লা সরবরাহে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের তদন্তপূর্বক কঠোর ব্যবস্থার দাবি জানান।
বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাপানের তৈরি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি (মেশিনারিজ) অত্যন্ত উন্নতমানের। যন্ত্রপাতির কোনো ত্রুটি নেই। সমস্যা কেবল এক জায়গায়, অর্থাৎ নিম্নমানের কয়লা। মানসম্মত কয়লা সরবরাহ করা গেলে পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতানুযায়ী এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শতভাগ নিশ্চিত করা কোনো বিষয়ই নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি ইউনিটে ৬০০ করে দুটি ইউনিটে উৎপাদন হওয়ার কথা এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৩ সালের আগস্টে কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট চালু হয়। প্রথমাবস্থায় মানসম্মত কয়লা সরবরাহ ছিল। সেই সময় নিরবচ্ছিন্ন পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎও উৎপাদন হয়েছে।
কেন্দ্রের একজন প্রকৌশলী শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জানিয়েছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) পরিচালিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জাপান থেকে যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এখানে এসে একটি বিষয়েই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। তা হচ্ছে কয়লার মান নিয়ে কোনোভাবেই আপস করা যাবে না। কিন্ত মানসম্মত কয়লার অভাবেই কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে।
কিন্তু গত ১৭ মার্চ মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সিঙ্গাপুরের পাতাকাবাহী ‘এমভি ওরিয়েন্ট অর্কিড’ নামের একটি জাহাজে করে আনা ৬৩ হাজার টন কয়লার সঙ্গে কাদা-মাটি মেশানো পাথরকাণ্ডের পর থেকে উন্নতমানের কয়লায় স্বস্তি ফেরেনি কেন্দ্রটিতে। ভারতীয় একটি কম্পানির সঙ্গে এদেশীয় মেঘনা গ্রুপ অব কম্পানির যৌথ পরিচালনায় ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লার চালানটি সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় ৬৩ হাজার কয়লার মধ্যে ২২ হাজার ৩৫০ টন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে খালাস করা হয়েছিল। কয়লার সঙ্গে ছিল বিপুল পরিমাণ কাদা মাটি। এ রকম নিম্নমানের কয়লা খালাসের সময়ও কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার বাধা ছিল না। জাহাজ থেকে কয়লা খালাসের সময় বারবার বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেল্ট ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে একমাত্র শ্রমিকরাই প্রতিবাদ জানিয়ে মাটি মেশানো কয়লা জাহাজ থেকে খালাসের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হলে বাদ বাকি ৪০ হাজার ৬৫০ টন কয়লা নিয়ে জাহাজটি ফিরিয়ে দেয়।
জানা গেছে, কেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলছে প্রায় চালানেই। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী জানান, সব কয়লা আনা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। তবে ইন্দোনেশিয়ার সব কয়লা খনির কয়লা এক রকম না। সেখানকার খনিতেও ভালো মান এবং নিম্নমানের কয়লার পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য রয়েছে দামেও। বেশি মুনাফার লোভে নিম্নমানের কয়লা সরবরাহের কারণেই হচ্ছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল সমস্যা, বলেন প্রকৌশলী। যতক্ষণ পর্যন্ত মানসম্পন্ন কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে না, ততক্ষণ বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এ রকম জোড়াতালির অবস্থা অব্যাহত থাকবে।
তিনি জানান, কেন্দ্রের দুটি ইউনিট পূর্ণদমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক দরকার ১০ হাজার টন কয়লা। সে হিসাবে মাসিক তিন লাখ টন করে এক বছরের জন্য ৩৫ লাখ টন কয়লা সরবরাহ দেওয়ার জন্য মেঘনা গ্রুপ অব কম্পানির সঙ্গে চুক্তি বলবৎ রয়েছে। সেই চুক্তির মেয়াদ অবশ্য এখন শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রকৌশলী আরো জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুই নম্বর ইউনিট গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিন সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে। মানহীন কয়লার কারণেই ইউনিটের যন্ত্রপাতিগুলো ধকল সহ্য করতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কয়লার কারণে কেন্দ্রের এক নম্বর ইউনিটের বয়লারেরও করুণ দশা এখন। তবু অন্তত শাটডাউন না করে কোনো রকমে চালু রাখা হয়েছে। তা-ও উৎপাদন ক্ষমতার ৬০০ মেগাওয়াটের স্থানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট।
সৌজন্য: কালের কণ্ঠ