জাতীয় সংসদ হলো সরকারি ও বিরোধী দল সমন্বয়ে নীতিনির্ধারণীর একটি সাংবিধানিক কাঠামো। সরকারি দল জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তাদের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকবে, অন্যদিকে বিরোধী দল ছায়া সরকারের প্রতিনিধিস্বরূপ অনিয়মতান্ত্রিক পথে এগোচ্ছে কি না দেশ... অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে। যেখানে যুক্তিতর্কে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করবে, তেমন প্রাণবন্ত সংসদের প্রত্যাশা জনগণের। জনগণের ভোটাধিকার হরণের কারণে বিগত ১৫ বছর জাতি তা থেকে বঞ্চিত ছিল। হবেই বা কেমন করে, যেহেতু নির্বাচনটাই সঠিকভাবে হয়নি, তাই সংসদ ছিল পুরোপুরি অকার্যকর। সবকিছুতেই যেন অনিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। দেশ সঠিকভাবে চলেনি বলেই একসময় দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ ক্ষেপে গেল। তাদের আহ্বানে যখন দেশবাসী ফুঁসে উঠল স্বৈরাচারী সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হলো।
পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব নেয়। প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববরেণ্য ড. ইউনূসের ওপর জনগণের প্রত্যাশা অনেক। অতীতে দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে। কিন্তু এ সরকারের ক্ষেত্রে বাস্তবতা ভিন্ন। আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা এবং ভেঙে পড়া প্রশাসনিক কাঠামো সঠিক পথে আনাই ছিল চ্যালেঞ্জিং। কোনো কিছুই সঠিকভাবে চলেনি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের সংস্কারের দাবি ওঠে এবং সরকারকে সেই পদক্ষেপ নিতে হলো। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দল সুশীল সমাজ থেকে সংস্কার বিষয়ে লিখিত ও মৌখিক আকারে মতামতও নেওয়া হয়। সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের পর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ব্যাপকভাবে মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভার মাধ্যমে নির্বাচনসংক্রান্ত ১২টি বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছে। সংস্কারসংক্রান্ত আলোচনায় পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি বেশি আলোচিত হয়। নির্বাচনের ব্যাপারে পুলিশের সংস্কার অত্যাবশ্যক ছিল।
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। দীর্ঘসূত্রতার অজুহাতে সংস্কার কখনই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও যদি সংস্কার বিষয়ে অগ্রগতি দেখা না যায় জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হতে বাধ্য। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে ভাটা, বেকারত্বের অভিশাপে জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা। অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিলে জনগণের কাছে কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। বিএনপি মনে করে সংস্কারের কার্যক্রমের বিষয়টি নির্বাচিত সরকারই বাস্তবায়ন করতে পারে। বিএনপি সংস্কার বিষয়ে ৩১ দফা কর্মসূচি বহু আগেই ঘোষণা করেছে। তাদের ধারণা, ৩১ দফা কর্মসূচি হলো রাষ্ট্র মেরামতের সনদ। এটা নিয়ে দেশব্যাপী প্রচারণাও চালিয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। অবশ্য এরকম কর্মসূচি অন্যান্য দলের বেলায় দৃশ্যমান হয়নি।
জামায়াত ও এনসিপি বলছে যেনতেনভাবে নির্বাচন মেনে নেওয়া হবে না। বিএনপি ও নাগরিক অধিকার পরিষদের বক্তব্য হলো নির্বাচন বিলম্ব করা হলে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন বিলম্বের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় যাচ্ছে। চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে এসেছে আগে ঘুষ দিতে হতো ১ লাখ টাকা, এখন ৫ লাখ। অর্থাৎ দেশে ঘুষের লেনদেন থেমে নেই। উল্টো পতিত সরকারের চেয়ে বেড়েছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন মহাসচিব। যারা ’২৪-এর গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন এরাও চাঁদাবাজিতে ধরা খাচ্ছেন। সম্প্রতি গুলশানের চাঁদাবাজিতেই প্রমাণ হয় চাঁদাবাজি কোন পর্যায়ে গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেত্রী উমামা ফাতেমার উক্তিতে প্রমাণ মেলে যেমন ‘জুলাইকে মানি মেকিং মেশিনে পরিণত করা হয়েছে’ এবং বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘কয়েকজন সমন্বয়কের চাঁদাবাজির খবরে বেদনায় নীল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, একি পরিণতি এটিই কি আমরা চেয়েছিলাম। দেশের মানুষ কি কেউ এটা চেয়েছিল? এত তাড়াতাড়ি যদি এ ঘটনা ঘটে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?’
রাজনৈতিক সরকার দায়িত্বে থাকলে জনগণের প্রতি এদের দায়বদ্ধতা থাকে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের ইমেজ ঠিক রাখার জন্য এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের তেমনটা দরকার পড়ে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, বিচারব্যবস্থার কাঠামো ঠিক করা, বাণিজ্য ব্যবস্থা সহজীকরণ, বিনিয়োগের প্রতি আস্থা সৃষ্টি করা দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। আজকে যারা যুবসমাজ তারা বিগত ১৫ বছর ভোট দিতে পারেননি। তারা দেখেছেন দিনের ভোট রাতে নিতে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য, আবার নির্বাচনের নামে তামাশা করে ডামি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এটা শুধু সংসদের বেলায় নয়, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি বিদেশি পত্রিকায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন করবেন।’ তিনি সে পথেই এগোচ্ছেন। এখন প্রয়োজন দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা। সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট