রপ্তানি খাত বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবসার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রপ্তানি খাতে ব্যাংকের অর্থায়ন, সহায়তা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ।
ব্যাংক ব্যবসায় রপ্তানি খাত কতটা গুরুত্ব বহন করে?
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে রপ্তানি একটি মৌলিক চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত, যা জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ব্যাংকগুলো রপ্তানি-সম্পর্কিত কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, বাণিজ্যিক সহায়তা এবং বৈদেশিক লেনদেন পরিচালনায় বিভিন্ন সেবা প্রদান করে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জোরদারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। রপ্তানি খাত শুধু ব্যাংকের লাভজনক কার্যক্রম নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির গতিপ্রবাহে প্রাণসঞ্চারকারী এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। যেমন-বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে তৈরি পোশাক ব্যাংকিং খাতের নিবিড় সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে রপ্তানি বিল সংগ্রহ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ব্যাংকগুলোর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরোপ করা এলসি মার্জিন সার্কুলারের বিষয়ে আপনার মতামত কী?
বাংলাদেশ ব্যাংক লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) মার্জিন বৃদ্ধির মাধ্যমে কিছু পণ্যের আমদানিতে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। এ সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হলো অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করা, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষা করা এবং সম্ভাব্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। স্বল্প মেয়াদে এ পদক্ষেপ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হলেও, দীর্ঘ মেয়াদে এটির আমদানিনির্ভর ব্যবসা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এই নীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ব্যবসা ও শিল্প খাতের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত বিঘ্ন এড়াতে এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ ও স্বচ্ছ যোগাযোগ নিশ্চিত করাই হবে সময়োচিত পদক্ষেপ। সেটি করা হচ্ছে, এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করা হয়েছে।
দেশের আমদানি ও রপ্তানিতে পার্থক্যের কারণ ও সমাধান কী হতে পারে?
বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণের মধ্যে বিরাট পার্থক্যের প্রধান কারণ হলো বাণিজ্য ঘাটতি, যেখানে আমদানির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে রপ্তানিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা একাধিক কাঠামোগত ও নীতিগত কারণ দ্বারা প্রভাবিত। তা সমাধানে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। যেমন- রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, কৃষি পণ্য, আইটি এবং পাটজাত পণ্যের মতো খাতে রপ্তানির সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করতে হবে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিনিয়োগ-তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল ও উপকরণ দেশেই উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। এ ছাড়া বাজার সম্প্রসারণসহ আরো নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
নীতিগতভাবে সরকার কী করতে পারে?
বাংলাদেশে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক নীতিগত ও কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার। শুল্ক সংস্কার, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানোর নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ সরকার আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত শুল্ক ও অশুল্ক বাধা হ্রাসে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ব্যাবসায়িক খরচ কমাতে এবং রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে; নির্দিষ্ট পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়েছে; শুল্ক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ও ব্যাংক ব্যবসায় কেমন প্রভাব ফেলবে?
ট্রাম্প প্রশাসনের পারস্পরিক শুল্কনীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি রপ্তানির ওপর প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই সিদ্ধান্ত শুধু রপ্তানি প্রবাহকে বিঘ্নিত করবে না, বরং ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতেও নেতিবাচক চাপ তৈরি করবে।
ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি পেলে রপ্তানিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
ব্যাংকঋণে সুদের হার বৃদ্ধি পেলে রপ্তানিকারকদের ঋণ গ্রহণের খরচ বৃদ্ধি পায়, যা রপ্তানি প্রতিযোগিতা এবং পরিমাণ হ্রাসের কারণ হতে পারে। এই প্রভাব প্রশমিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ভর্তুকিযুক্ত রপ্তানি ঋণ, বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির জন্য একটি স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার মতো লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ বিবেচনা করতে পারে। উচ্চ সুদের হার রপ্তানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে, কারণ মূলধন ব্যয় বেড়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ বিলম্বিত হয়। এ ছাড়া সুদের হার পরিবর্তন বিনিময় হারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা রপ্তানির প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করে। যেমন- উচ্চ সুদের হার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করলে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য বেড়ে যায় এবং রপ্তানি পণ্য আরো দামি হয়ে পড়ে।
এ ক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে?
বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ভর্তুকিযুক্ত সুদের হার প্রণোদনা দিতে পারে, যা রপ্তানিকারকদের ঋণ খরচ কমিয়ে তাঁদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্ত করবে। যেমন-মার্কিন ডলারে ইডিএফ সুবিধা পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। বিকল্প অর্থায়নের প্রচার- রপ্তানি ফ্যাক্টরিং, ফোরফাইটিংয়ের মতো বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা উৎসাহিত করতে হবে, যা ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা কমাবে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্বাভাসযোগ্য বিনিময় হার নিশ্চিত করে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি, যা রপ্তানিকারকদের পরিকল্পনা ও বিনিয়োগে সহায়ক হবে। সর্বোপরি রপ্তানি খাতে সুদের হার ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে মুদ্রানীতিতে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা যেতে পারে।
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ