ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে কে জিতেছে, কে হেরেছে তা বলা দায়। তবে দুই দেশের যুদ্ধবিরতি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আগ্রহে। ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়েছিল তাদের পারমাণবিক সামর্থ্যরে ইতি ঘটাতে। সেক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়েছে চূড়ান্তভাবে। আগেভাগে পারমাণবিক উপকরণ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কারণে। ইরানের ধর্মীয় শাসনের ইতি ঘটাতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধে ইরান প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছিল সেদেশের কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। যারা ইরানের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিল শত্রুপক্ষের কাছে।
বিশ্বাস শব্দটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য অনেক বড়। বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লাগে বছরের পর বছর, কিন্তু ভাঙতে সময় লাগে কিছুক্ষণ। একজন ভালো মানুষ বা ভালো বন্ধু হওয়ার প্রথম শর্ত হলো বিশ্বাসী হওয়া। বিশ্বাস যদি ভালোবাসার প্রথম ধাপ হয়, তাহলে বিশ্বাসঘাতকতা হলো সম্পর্কের শেষ ধাপ। তাই তো বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী সিগমুড ফ্রয়েড বলেছেন, ‘সব অপরাধের চেয়ে বড় অপরাধ হলো বিশ্বাসঘাতকতা।’
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু সেরা জীব হলেও মানুষের মধ্যে অনেক ঘৃণিত অভ্যাস রয়েছে, যার অন্যতম হলো বিশ্বাসঘাতকতা। পৃথিবীর সর্বত্রই এমন কিছু ঘৃণ্য স্বভাব-চরিত্রের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, যারা অতীতের সব উপকার অস্বীকার করে উপকারীর বুকে ছুরিকাঘাত করতে দ্বিধাবোধ করে না। যুগে যুগে এমন কিছু বেইমান বা বিশ্বাসঘাতকের আবির্ভাব ঘটে যাদের কারণে জাতি বা রাষ্ট্রকে পর্যন্ত চরম মূল্য দিতে হয়। এমনই একজন জঘন্য প্রকৃতির বিশ্বাসঘাতক মানুষ ছিলেন মীরজাফর আলী খান।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার করুণ পরাজয়ের কাহিনি আমরা সবাই জানি। এর নেপথ্যে ছিলেন কুচক্রী বিশ্বাসঘাতক প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খান। ক্ষমতার মোহ আর সম্পদের লোভ তাকে পেয়ে বসে। রাতের অন্ধকারে ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়কে নিশ্চিত করেন তিনি। এই যুদ্ধে সিরাজ-উদ- দৌলা পরাজিত হন এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়।
প্রাচীনকাল থেকে ভারত উপমহাদেশ- বিশেষ করে বাংলা অঞ্চল ছিল ধনসম্পদে ভরপুর একটি দেশ। এ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে মানুষের জীবনযাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই তখন পাওয়া যেত। অর্থাৎ প্রতিটি গ্রামই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষকের খেতভরা ফসল, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ থাকত। কুটিরশিল্পেও গ্রাম ছিল সমৃদ্ধ। তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় ইউরোপের কাপড়ের চেয়েও উন্নতমানের ছিল। এর মধ্যে জগদ্বিখ্যাত ছিল মসলিন কাপড়। তা ছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও নানা ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য ও মসলার জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব পণ্যের আকর্ষণে অনেকেই এ দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে এসেছে। ইংরেজ বণিকদের ব্যবসায়িক সংস্থা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এসেছিল ব্যবসাবাণিজ্য করতে। পরবর্তী সময়ে তারা নানামুখী ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্থানীয় শাসকদের পরাভূত করে এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হয়।
এভাবেই ক্রমে বাংলার বুকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের নামে শোষণের শেকড় গেড়ে বসে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা
ইচ্ছামতো বাণিজ্য করতে থাকে। শুধু কী তাই? এ দেশ থেকে বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ নির্বিচারে জাহাজ বোঝাই করে তারা পাচার করত। বিভিন্ন দ্রব্য তাদের প্রয়োজনানুসারে উৎপাদন না হলে তারা কৃষকদের উৎপাদনে বাধ্য করত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উৎপাদনে বাধ্য করার জন্য কৃষকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। অর্থাৎ ইংরেজদের শোষণের অন্যতম শিকার ছিলেন বাংলার সাধারণ জনগণ তথা কৃষক সমাজ।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাংলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একপর্যায়ে প্রতিবাদ শুরু করে। যে যেভাবে পারে, কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শুরু করে। বিদ্রোহটি দ্রুতই সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে এবং শক্তিশালী রূপ নেয়। ফলশ্রুতিতে কোম্পানি শাসনের পতন হয় বাংলাসহ পুরো ভারতবর্ষে। এরপর ভারতবর্ষে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের শাসন শুরু হয়। শুরু হয় একটি নতুন আমলের। ইংরেজদের ২০০ বছরের শাসনকাল মোট দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগে শাসন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই শাসনকাল ছিল পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত। এর পরবর্তী সময় অর্থাৎ ভারত ভাগ হওয়ার আগ পর্যন্ত সরাসরি শাসন করেন ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ।
বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের কারণেই ২০০ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হয় বাঙালি জাতিকে। তবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করেনি। জীবনের শেষ পরিণতিই তা প্রমাণ করে। ইতিহাস এ কথাও বলে, মীরজাফর কখনোই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না। মীরজাফর ছিলেন বিশ্বাসঘাতকদের বানানো একটা হাতের পুতুল; যার নিজের কোনো যোগ্যতা ছিল না। যখনই তার দ্বারা বিশ্বাসঘাতকদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে, তখনই তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত চক্রান্তবাজদের চেহারা।
আসলে মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছিল অনেক পরে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে যে সরাতে হবে তার প্ল্যান অনেক আগেই করে রেখেছিলেন তিন বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও রাজবল্লভ মিলে। জগৎশেঠের বাড়িতে এক গোপন মিটিং হয়। সেই মিটিংয়ে মহিলার ছদ্মবেশে পালকিতে করে যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজ দূত ওয়াটস। মিটিংয়ে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় ছলে-বলে-কৌশলে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে, তবে কোনোভাবেই মুসলমানদের উত্তেজিত করা যাবে না। মি. ওয়াটস তখন বলেন- সিরাজের সঙ্গে লড়তে গেলে বিরাট অর্থের প্রয়োজন হবে তা আমরা কোথায় পাব! উত্তরে জগৎশেঠ বলেন, টাকা যা লাগে আমি দেব কোনো চিন্তা নেই।
এই মিটিংয়ের পর সিরাজকে সরাতে ঘসেটি বেগমকে বোঝানোর দায়িত্ব ছিল রাজা রাজবল্লভের ওপর। আর মীরজাফরকে বোঝানোর দায়িত্ব ছিল উমিচাঁদের ওপর। উমিচাঁদ মীরজাফরকে লোভ দেখান এবং বলেন, তুমি আমাদের দলে থাকলে তোমাকে পরবর্তীতে সিংহাসনে বসানো হবে। এরপর জগৎশেঠের বাড়িতে দফায় দফায় মিটিং হয়। সেখানে উপস্থিত থাকেন জগৎশেঠ, রাজা রায় দুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ওই মিটিংয়ে সিদ্বান্ত হয়, মীরজাফরকে দিয়েই সিরাজকে সরাতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত তাই হলো। সিংহাসনের লোভে মীরজাফর যেন উন্মাদ হয়ে গেলেন। তার অধীনের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজয় বরণ করতে হলো। অর্থাৎ বাংলার পতনের মূল কারণ ছিল মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা।
ওই সময় মীরজাফর এতটাই বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠেন যে, ক্ষমতার লোভে নবাবকে ধ্বংস করার জন্য, সে সংকল্পবদ্ধ তা কোনোভাবেই সিরাজকে বুঝতে দেননি। উল্টো পবিত্র কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করেন, বাংলার মসনদের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। তাই যে কোনো মূল্যেই হোক পলাশীর যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনবেন। আর তিনিই কি না এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলেন!
আর এজন্যই মীরজাফর নামটি এখন বাংলার মানুষের কাছে একটি ঘৃণিত নাম, যার প্রতিশব্দ হলো বেইমান। এ নামটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোনো বাঙালিই তার সন্তানের নাম মীরজাফর রাখে না। এটি একটি ঐতিহাসিক চরিত্র হলেও মীরজাফর শব্দটি বিশ্বাসঘাতকের অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। যতদিন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস থাকবে; ততদিন পর্যন্ত এ নামটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হবে।
আমাদের আশপাশে যে মানুষগুলো আছে, তাদের অনেকের মধ্যে মীরজাফরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে, তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে। এ সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে যারা কাজ করে তারা এ দেশেরই কিছুসংখ্যক বেইমান-বিশ্বাসঘাতক মানুষ। নিজেদের স্বার্থে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস তো মীরজাফরেরই অন্য একটি রূপ। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম চরিত্র মীরজাফর মরে গেলেও বিশ্বাসঘাতকের বেশে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে তার প্রেতাত্মারা; আমাদের চারপাশে যা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত। তাই তো মীরজাফররা যুগে যুগে। তাদের রুখে দিতে আমাদের হতে হবে বদ্ধপরিকর।
একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। একবার বাদশাহ হারুনুর রশীদের কাছে এক লোক একটি চাতক পাখি বিক্রি করার জন্য নিয়ে এলো। তিনি দাম জিজ্ঞেস করলে সে বাজারমূল্যের চেয়েও অনেক বেশি দাম চাইল। বাদশাহ জানতে চাইলেন, পাখিটির এত দাম কেন? অথচ তার একটি পা নেই!
লোকটি বলল, মার্জনা করবেন জাঁহাপনা। দেখতে সাধারণ হলেও এটি আসলে একটি বিশেষ ধরনের পাখি। এর বিশেষত্ব হলো- আমি যখন শিকারে যাই, তখন এই চাতক পাখিটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাই। আমার পাতানো ফাঁদের সঙ্গে এই পাখিটিকেও বেঁধে রাখি। এই পাখিটি তখন এক অদ্ভুত আওয়াজ করে অন্য পাখিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তার এই আওয়াজ শুনে ঝাঁকে ঝাঁকে অন্য পাখি এসে জড়ো হয়। তখন আমি একসঙ্গে সব পাখিকে শিকার করি। বলা যায় এই পাখিটিই আমার শিকারের প্রধান ফাঁদ।
বাদশাহ খুব মনোযোগ সহকারে শিকারির সব কথা শুনলেন এবং তার চাহিদা অনুযায়ী চড়া দামেই পাখিটি কিনলেন। তিনি মনে মনে এ কথাও ভাবলেন, এ দুষ্ট পাখিটির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গে পাখিটাকে জবাই করে ফেললেন। শিকারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জাঁহাপনা! অনেক দামে কেনা পাখিটি এভাবে জবাই করে দিলেন?
তখন বাদশাহ হারুনুর রশীদ তাকে বললেন,
‘যে তার স্বজাতির সঙ্গে অনায়াসে এমন গাদ্দারি করতে পারে, তার এই পরিণতিই হওয়া উচিত!’
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক