ইরানে কী করতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প? কী পরিকল্পনা জায়নিস্ট নেতানিয়াহুর? ইরান ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কি পাগলতত্ত্বের চর্চা করছেন? এটা হচ্ছে ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ ধরনের একটা বিদঘুটে ফরেইন পলিসি। আমেরিকার ৩৭তম প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন নাকি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই পলিসি অনুসরণ করতেন। প্রতিপক্ষ বিশেষ করে কমিউনিস্ট ব্লককে আমেরিকার নীতি সম্পর্কে ভুল বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। এমন সব পাগলাটে ও অর্থহীন কথাবার্তা বলা হচ্ছিল মস্কো ও বেইজিং (তখন ছিল পিকিং) যাতে বুঝতে না পারে, আসলে ওয়াশিংটন কী করতে চাইছে! নিজেদের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে ধোঁয়াশা তৈরি করাই ছিল উন্মাদতত্ত্বের সারকথা। একদিকে নিক্সন দৌড়ঝাঁপ করছিলেন স্নায়ুযুদ্ধের তীব্রতা কমিয়ে আনার চেষ্টায়। আরেকদিকে ভিয়েতনামে অগ্নিগোলক তথা নাপাম বোমা মেরে রক্তের বন্যা বইয়ের দেওয়ার প্রক্রিয়া জারি রেখে তিনি প্রদর্শন করেছিলেন ম্যাডম্যান থিউরির পরাকাষ্ঠা। নাপাম গার্লের সেই মর্মস্পর্শী ছবিটি সেদিন বিশ্বমানবের বিবেক কাঁপিয়ে দিয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা বক্ষবিদীর্ণ করা সেই ছবি দেখে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছিলেন, এটা মনে হয় বানানো ছবি। তা সত্ত্বেও বিশ্বজনমতের চাপে ১৯৭৩ সালে তিনি ভিয়েতনামে যুদ্ধাবসানের ঘোষণা দিলেন। কিন্তু যুদ্ধ থামল না। সে ভিন্ন ইতিহাস।
সে যা-ই হোক এই স্থূলপন্থায় নিক্সন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি সমুন্নত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই সেই পাগলতত্ত্ব ব্যর্থ পরিহাস হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছিল। ভিয়েতনাম রণাঙ্গনে আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। শেষমেশ রক্ষা করতে পারলেন না নিজের গদিও। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের কাছে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করতে হলো রিচার্ড নিক্সনকে।
আর এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প কখন কী বলছেন তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। একবার মনে হয় তিনি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের দ্রুত অবসান চান, আরেকবার এমনভাবে কথা বলেন যাতে মনে হয় তিনি আমেরিকার নয় ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট। ১৩ জুন রাতের অন্ধকারে ইরানে পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, এই হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো যোগ নেই। ইরান তবু যদি আমেরিকার ঘাঁটি আক্রমণ করে তাহলে কঠিন মূল্য দিতে হবে। আর এখন বলছেন, ‘ইরানের তথাকথিত সর্বোচ্চ নেতা খমেনি কোথায় লুকিয়ে রয়েছেন, তা আমরা জানি। কিন্তু আমরা তাকে অন্তত এখনই ধরব না।’ তিনি এ-ও বলেছেন, ‘ইরানের আকাশ আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।’ যুদ্ধ হচ্ছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে। আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলছেন, ‘আমরা জানি’, ‘আমাদের দখলে’! মানে কী? পাগল আর কাকে বলে? ট্রাম্পের এ ধরনের ডায়ালগ কোনো স্টেটসম্যানের মুখে শোভা পায় না। এগুলো মেঠোগুন্ডাদের ভাষা। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, তারা খামেনিকে হত্যা না করা পর্যন্ত থামবেন না। আর ট্রাম্প বলেন, হত্যা করা ঠিক হবে না। নেতানিয়াহু বলেন তাদের লক্ষ্য শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। ট্রাম্প চান ইরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।
কিন্তু ইরান আত্মসমর্পণ করবে না। ইরান স্পষ্ট করে এ-ও জানিয়েছে, তারা কখনোই আমেরিকার পা চাটবে না। বস্তুত ইরান একাই লড়ে যাচ্ছে। জায়নবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে ইরান শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তেল আবিব তেহরানে শাসক পরিবর্তন করতে চাইছে। এই চাওয়া হয়তো ওয়াশিংটনেরও।
এদিকে ইরানের বিতাড়িত শাহানশাহের পুত্র রেজা শাহ পাহলভি মিসরে বসে ইসলামি শাসনের পতন ঘটিয়ে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছক কষছেন। তিনি ইরানিদের উদ্দেশে এক বার্তায় খামেনির শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৩ জুন ইরানে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অব্যবহিত পর রেজা শাহ এই আহ্বান জানান। রেজা শাহ পাহলভির প্রতি ইসরায়েল ও আমেরিকার সমর্থন থাকা বিচিত্র নয়। রেজাশাহর পিতা মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি ছিলেন ইসরায়েল ও আমেরিকার পরম মিত্র। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশটির নাম আমেরিকা। মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির ইরানও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কাছাকাছি সময়ই। ইরান ছিল দ্বিতীয় মুসলিম দেশ, যে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই শাহানশাহের পুত্রের প্রতি ইসরায়েল ও হোয়াইট হাউসের সমর্থন থাকাই স্বাভাবিক।
ইসরায়েল ও আমেরিকার আগ্রাসনের মুখে খামেনির প্রশাসনের অবসান ঘটলে কে বা কারা পরিত্যক্ত মসনদটি অধিকার করবে, সে আলোচনা এখানে জরুরি নয়। তবে আমেরিকা ও ইসরায়েল যে ইরানের বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত করতে চাইছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার মতো পরিণতির দিকে ইরানকেও ঠেলে দেওয়ার বাসনা যে তাদের রয়েছে, তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়।
আফগানিস্তানে মার্কিন জোট হামলা চালিয়েছিল আল-কায়েদার নেতা উসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে। মোল্লা ওমরের সরকার উৎখাত করে কাবুলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আমেরিকার বশংবদ সরকার। আর ২০০৩ সালে গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুতের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে ইরাক আক্রমণ করা হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর অনুসন্ধানী দল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ইরাকের কোথাও কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র পায়নি। অসত্য অভিযোগে ইরাকের ওপর ভয়াবহ যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলো, দেশটির সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানা হলো। কিন্তু সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কোনো দোষ দেওয়া হলো না। অথচ বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো সাদ্দাম হোসেনকে। বাগদাদে কায়েম করা হলো ওয়াশিংটনের অনুগত তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার। ইরাকে স্থাপন করা হলো মার্কিন ঘাঁটি। ইরাক এখন বস্তুত আমেরিকার এক অঘোষিত উপনিবেশ।
২০১১ সালে তথাকথিত আরব বসন্তের ঢেউ আছড়ে পড়ে লিবিয়ায়। মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে ন্যাটো জোট লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করল। ন্যাটোর মদতে গণবিক্ষোভ চরমে উঠলে মুয়াম্মার গাদ্দাফি আত্মগোপন করেও বাঁচতে পারেননি। নির্দয়ভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের এই মহান নেতাকে হত্যা করা হয়। লিবিয়ার তেলসম্পদের ওপর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হলো আমেরিকা ও তার মিত্রদের।
ইসরায়েল ও আমেরিকা একই জিনিস হয়তো করতে চায় ইরানেও। তা চাইলেও বাস্তবে সেটা বোধ হয় হওয়ার নয়। কেননা ইরানের নৈতিক শক্তির ভিত খুবই মজবুত। একটি ইসলামিক দেশ হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তেহরান সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট নয়। ইরানের নাগরিক ইহুদিরাও এখানে নিরাপদ। এমনকি ইরানের পার্লামেন্টেও তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সামরিক দিক দিয়েও ইরান যথেষ্ট শক্তিশালী। শক্তির তুলনায় তেহরানের আস্ফালন অনেক কম। সাদ্দাম হোসেন বা লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতো লম্বা কথা বলার স্বভাব থেকেও ইরানের নেতারা মুক্ত বলেই প্রতীয়মান হয়। পক্ষান্তরে ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ কসাই নেতানিয়াহু নিজেদের অপরাজেয় মনে করলেও বাস্তবে তার সক্ষমতা যে সীমাবদ্ধ তা আজ আর অপ্রকাশিত নেই। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসছে। তার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুতও ফুরিয়ে এসেছে।
আরেক বাস্তবতা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্ববিরোধী ও পাগলাটে কৌশল খুব বেশি দিন কাজ করবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকসাধারণ ইসরায়েলকে নিয়ে ত্যক্তবিরক্ত। ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই রিপাবলিকানদেরও অনেকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদের বক্তব্য ইসরায়েল একটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম দেশ। তারা যুদ্ধ করে করুক, আমেরিকার তাতে কী? যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের ট্যাক্সের টাকা কেন ইসরায়েলের পেছনে ব্যয় করা হবে? আর ট্রাম্প যে ইলেকশনের আগে ও পরেও বলছিলেন তার নীতি হলো ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। অন্য কোনো দেশের জন্য আমেরিকা অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করবে না। আর এখন ইসরায়েলের জন্য ট্রাম্প যা কিছু করছেন তার সঙ্গে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির মিল কোথায়?
ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে শান্তিবাদীদের দলে নিজের নাম লেখান। তিনি তখন বলেছিলেন, মানুষ হত্যার এই যুদ্ধের অবসান চাই। রাশিয়া যদি যুদ্ধাবসানে রাজি না হয়, তাহলে আমি বলব, তারা বোকা, তারা গর্ধব। তার এই প্রচেষ্টা দেখে ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনয়ন দেন বেশ কয়েকজন প্রস্তাবক। আজ যখন মি. ট্রাম্প ইরান ইস্যুতে ইসরায়েলের হয়ে হুমকিধমকি দিয়ে চলেছেন তখন হয়তো সেই প্রস্তাবকরা হতবাক।
মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশ আক্রান্ত ইরানের পক্ষে বুক চিতিয়ে না দাঁড়ালেও ইরান কিন্তু লিবিয়া বা ইরাকের মতো নিঃসঙ্গ নয়। ইরাক ও লিবিয়া যখন আক্রান্ত হয়, তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি আর হালফিল পরিস্থিতি মোটেই এক রকম নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার তখন নিজেরই কঠিন অবস্থা। নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই হলে রাশিয়া ও চীনও সমর্থন দেয়। কারণ টুইন টাওয়ারে হামলাটি ছিল অকল্পনীয় ও মৃত্যুভয়াল। সেই বিভীষিকা স্তব্ধ করে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে।
জিওপলিটিক্যাল সিনারিও বদলে গিয়েছিল। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের অংশ হিসেবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। আজও যদি সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই করতে হয়, তবে সেটা করতে হবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসের শিরোমণি হিসেবে যদি কারও শাস্তি পাওনা হয়ে থাকে, তবে সে নেতানিয়াহু ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। ইরান কোনো সন্ত্রাসবাদী দেশ নয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক