রাজনীতিতে পলিটিক্স্ ঢুকে গেছে-এ কথাটি কে যে বলেছিলেন জানি না। তবে অনেকেই খুব জ্ঞানীর মতো বাক্যটি বলেন। যিনি এটি প্রথম বলেছেন তিনি অবশ্যই জ্ঞানী। তা না হলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা এতটা উপযোগী হবে কেন? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব হলো জনগণের ভোটাধিকার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রতিষ্ঠা। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দেশে আগামী নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছেন। এর আগে থেকেই অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসছে। আর তিনি জাপান সফরে গিয়ে বলেছেন যে মাত্র একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। তার সে বক্তব্য কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হলেও কোনো বিতর্কই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। সে কারণেই তিনি যা ভাবছেন সেটাই করছেন। তার কাছে যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মনে হয়েছে, তিনি তাদের মতামতই গ্রহণ করেছেন। সুতরাং সূর্যোদয় দেখে যেমন দিনটা কেমন যাবে বোঝা যায়, তেমন প্রধান উপদেষ্টার এপ্রিল ঘোষণা থেকেও বোঝা যাচ্ছে কেমন হবে আগামীর গণতন্ত্র। আগামী সময়ে আমরা জনগণের ভোটের গণতন্ত্র পাব, নাকি নিজেদের পছন্দের গণতন্ত্র পাব সেটাই এখন দেখার বিষয়। সুতরাং সাধু সাবধান!
প্রধান উপদেষ্টার এপ্রিল ঘোষণার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি এপ্রিল মাসকে ‘ফ্যান্টাস্টিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। গত রবিবার রাতে তিনি এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। এপ্রিলে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের পেছনে তিনটি কারণের কথা জানিয়েছেন তিনি। এগুলো হলো-সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ১২ থেকে ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং তাদের রিপোর্ট আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা চলছে। সে রিপোর্টগুলো নিয়ে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে ট্রায়াল। জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার করা। এ সময়টায় ভয়ানক রকম একটা হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। চার বছর, ছয় বছরের শিশুরাও মারা গেছে। ট্রায়াল হওয়াটা খুবই জরুরি। তবে ট্রায়ালটা এমনভাবে হওয়া উচিত, যেটা ডিউ প্রসেস এবং ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলে। এগুলোর জন্য সময় প্রয়োজন। পাশাপাশি ইলেকশনটা যেন খুবই নিরপেক্ষ, ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার হয়, সেটার জন্য আয়োজনের একটা বিষয় আছে। এ প্রতিটি বিষয় লক্ষ করে চিফ অ্যাডভাইজার এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় দিয়েছেন।’
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ওই সময়ের আবহাওয়া নির্বাচনের জন্য অনুকূল নয় বলে প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রশ্নে শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহে টেম্পারেচার বেশি থাকে; দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহে বেশি। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চতুর্থ সপ্তাহে টেম্পারেচার বেশি থাকে। তারা বলেছেন, প্রথম ১০ দিন টেম্পারেচার মোটামুটি ঠিক থাকে। এ সময়টায় এত হিট ওয়েভ থাকে না যে ইলেকশন করা যাবে না।’ কালবৈশাখির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কালবৈশাখি শব্দটার মধ্যেই বৈশাখ মাস আছে। বৈশাখ মাসেই এটা বেশি হয়। আবহাওয়াবিদরাও বলেছেন এপ্রিলের প্রথম নয়টা দিন কালবৈশাখি হয়। তা-ও এটা খুব লোকালাইজড হয়, দেশব্যাপী হয় না। এটাও হয় এপ্রিলের সেকেন্ড হাফে বেশি; যখন বৈশাখ মাসটা শুরু হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে এপ্রিলের প্রথমার্ধটা একটা ফ্যান্টাস্টিক টাইম।’
সরকার ও সরকারের প্রিয়ভাজনদের জন্য সত্যি এটা ফ্যান্টাস্টিক টাইম। সময় নির্ধারণের জন্য সরকার আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশে অতীতে কখনো আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের বিষয়ে কোনো সরকার কথা বলেছে কি না দেশবাসীর জানা নেই। তবে এখন সংস্কার ও পরিবর্তনের সময়। এখন সবকিছুকেই গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু গুরুত্ব পেল না বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো।
এখন পর্যন্ত মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে বিএনপিকে ঠেকাতে সরকারের অনেক আয়োজন। বিএনপি যা বলছে সরকার ঠিক তার উল্টোটা করছে। বিএনপির অপরাধ কী? বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের দল? এ দলের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক-এটাই কি অপরাধ? এ দলের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন-এটাই কি বিএনপির অপরাধ? এ দলের বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী-এটাই কি অপরাধ? এ দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছেন-এটাই কি বিএনপির অপরাধ? অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দল, যারা বিএনপির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে-এটাই কি তাদের অপরাধ?
দেশবাসী ও বিএনপির জন্য আরও কিছু চমক অপেক্ষা করছে। সরকার সংস্কার করার জন্য অনেক কমিশন গঠন করেছে। সব সংস্কারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য গঠন করেছে ঐকমত্য কমিশন। এ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তৈরি হবে জুলাই সনদ। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে। দিন শেষে দেখা যাবে বিএনপি যেসব বিষয়ে আপত্তি জানাচ্ছে সেগুলো জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত করে বলা হবে, বিএনপি ছাড়া সব রাজনৈতিক দল এসব বিষয়ে মত দিয়েছে। তখনো দেখা যাবে বিএনপিকে ঠেকানোর সূক্ষ্ম আয়োজন। এখন পর্যন্ত বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, গণভোট ও গণপরিষদের বিরোধিতা করে আসছে। জুলাই সনদ ঘোষণার পর স্থানীয় সরকার ও গণপরিষদ নির্বাচনের ঘোষণা যদি সরকার দেয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। সেই আয়োজনের জন্যই আরও ১০ মাস সময় নিল সরকার। এ ১০ মাসে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে পারে। যেসব সম্ভাব্য ঘটনা ঘটতে পারে সবই হবে বিএনপিকে ঠেকানোর নানান আয়োজন। বিএনপিকে ঠেকানোর এজেন্ডায় এখন দীর্ঘদিনের চেনা মিত্ররাও সুর পাল্টে নানান সুরে বাদ্য বাজাচ্ছে। নতুন স্বপ্ন, নতুন ন্যারেটিভ নিয়ে যারা বিপ্লব করেছে তারাও নানান কৌশলে বিএনপিকে ঠেকানোর প্রাণপণ চেষ্টায় লিপ্ত। সরকারের সঙ্গে নতুন-পুরান মিলে যাদের সম্পর্ক রসুনের গোড়ার মতো, তারা সবাই মনে করছে ক্ষমতায় যাওয়ার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। দেশের গণতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যতটা না মুখ্য বিষয়, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো ক্ষমতায় যাওয়া। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা সবাই ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেছেন। ক্ষমতাসীনদের যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসিয়েছেন তারা নিজেদের বড় মাফিয়া হিসেবে ঘোষণা করছেন। এক মাফিয়ার বিদায় হলেও আরেক মাফিয়া যদি নতুন ন্যারেটিভে সারা দেশে জেঁকে বসে, তাহলে যেই লাউ সেই কদুর অবস্থাই হবে। সরকার ইতোমধ্যে ১০ মাস পার করেছে। এপ্রিল ঘোষণায় আরও ১০ মাস হাতে রেখেছে। এখন পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে দেশে দৃশ্যমান কিছুই হয়নি। সব সেক্টরে এখন পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। মব ফ্যাসিজম এখনো দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণ কেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয় এখনো উত্তপ্ত। ঈদের ছুটির পর সচিবালয়ে কী পরিস্থিতি হবে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে খুব সহসা এ উত্তাপ বন্ধ হবে।
বর্ণচোরা শত্রুর চেয়ে প্রকাশ্য শত্রু অনেক নিরাপদ। বিএনপির সামনে এখন প্রকাশ্য শত্রুর অবস্থান পরিষ্কার। প্রকাশ্য শত্রুর সঙ্গে আরও কিছু মিত্রবেশী অপ্রকাশ্য শত্রু আছে যাদের রসুনের গোড়ার মতো একই এজেন্ডা হলো বিএনপি ঠেকানো। এ অবস্থায় বিএনপিকেও নতুন করে ভাবতে হবে। জাতীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের সব নেতা-কর্মীকে জনগণের পাশে থাকতে হবে। দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেভাবে নতুন ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা জনগণকে বোঝাতে হবে। সেই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ ডিজিটাল কর্মী। যারা ফেসবুক-ইউটিউবের মিথ্যা প্রপাগান্ডার জবাব দেবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় সত্যটা তুলে ধরবে। ডিজিটাল প্রপাগান্ডা মোকাবিলা করতে না পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বিএনপির বিরুদ্ধে এখনই দেশের ভিতরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র ডিজিটাল দুনিয়ায় ভয়াবহভাবে তৎপরতা শুরু করেছে। দেশি এ চক্রকে নানাভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছে বিদেশে অবস্থানকারী কিছু সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকটিভিস্ট। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, বিএনপির বিরুদ্ধে দেশিবিদেশি ডিজিটালযোদ্ধারা তত বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে। সুতরাং এখন থেকেই বিএনপিকে শক্তিশালী ডিজিটাল টিম গড়ে তুলতে হবে। সামনের সময়টা শুধু যে বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জিং তা নয়; বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষের সব শক্তির জন্যই ভয়াবহ ও বিপজ্জনক সময় অপেক্ষা করছে। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যাদের কাম্য ছিল না, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড যাদের গর্বিত করতে পারেনি, তারা কখনো স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারবে না।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন