রোবট শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে বেশ পরিচিত হলেও ড্রোন শব্দটি কিছুটা নতুন। উন্নত দেশে শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এমনকি গৃহের কাজেও রোবটের ব্যবহার বেশ দেখা যাচ্ছে। সে তুলনায় ড্রোনের ব্যবহার এখনো তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ল্যাবে ছোট ছোট ড্রোন বানাচ্ছে এবং তা বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় দেখাচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, খেলার মাঠে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে মাঝেমধ্যে মাথার ওপর ড্রোন ঘুরতে দেখা যায়। তবে এবারের পয়লা বৈশাখে জাতীয় সংসদ চত্বর ড্রোনের ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। প্রায় ১৫ মিনিটের প্রদর্শনীতে একসঙ্গে ২ হাজার ৬০০ ড্রোন ফুটিয়ে তুলেছিল ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি, স্বাধীনতার প্রতীক, শোষণ-শাসনের খাঁচা ছেড়ে পালানো পাখির দৃশ্য। দেখানো হয় অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের আবু সাঈদকে, বিক্ষোভকারীদের তৃষ্ণা মেটাতে পানি বিতরণ করা শহীদ মীর মুগ্ধকে। পর্যায়ক্রমে আকাশে ভেসে ওঠে বিপ্লবে-সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ, সাধারণ মানুষের প্রতীক হয়ে ওঠা রিকশাচালক, জাতীয় ফুল শাপলা, ১৯৭১ থেকে ২০২৪, জুলাই বিপ্লব, ফিলিস্তিনের জন্য প্রার্থনা, শান্তির দূত, চীন-বাংলাদেশের ৫০ বছরের বন্ধুত্ব এবং সব শেষে সবাইকে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো হয়। ‘ড্রোন শো’টি পরিচালনা করেন ১৩ জন চীনা পাইলট/বিশেষজ্ঞ (ডিজাইন টিম)। মূলত ড্রোন হলো একটি উড়ন্ত রোবট, যা দূরবর্তীভাবে নিয়ন্ত্রিত বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উড়তে পারে, যা অন বোর্ড সেন্সর এবং একটি গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (GPS) সঙ্গে একত্রে কাজ করে। ড্রোন ব্যবহারে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FAA) নিয়মাবলি, ভেন্যু এবং স্থানীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নিয়ম মেনে চলতে হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা উপলক্ষে ড্রোন শোয়ের আয়োজন করে থাকে। তবে গত কয়েক বছর ড্রোন শো বিশ্বব্যাপী বড় বড় ইভেন্ট দেখা যাচ্ছে। ২০১২ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রদর্শনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তির উন্নয়ন শুরু করে। পরে সুপার বোল হাফটাইম শো ও শীতকালীন অলিম্পিকের মতো ইভেন্টে ড্রোন শোয়ের আয়োজন করে ইনটেল এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে। ড্রোন শো-তে সিংক্রোনাইজড একঝাঁক ড্রোন আকাশে আলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ছবি সৃষ্টি করে। একটি বিশেষ সফটওয়্যার ড্রোনগুলোর জন্য ফ্লাইট কমান্ড তৈরি করে, যা প্রতিটি ড্রোনের গতি এবং আলোর পরিবর্তন সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এসব ড্রোন একসঙ্গে মিলে আকাশে অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি করে। প্রথমে ডিজাইন টিম একটি টাইমলাইন তৈরি করে, যেখানে নির্দিষ্ট কিছু ছবি ও ইফেক্ট থাকে। বিশেষ একটি সফটওয়্যার এসব ছবিতে অ্যানিমেশন যোগ করে, যেন ড্রোনগুলো অ্যানিমেশন অনুযায়ী চলতে পারে। এর সঙ্গে একটি সাউন্ড ট্র্যাকও থাকে। এরপর পুরো শোয়ের তথ্য রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে ড্রোনগুলোতে পাঠানো হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শো শুরু হয় এবং ড্রোনগুলো আকাশে ছবি আঁকতে শুরু করে।
উন্নত দেশগুলোতে ড্রোনের বহুবিধ ব্যবহার আছে। যেমন কৃষি ড্রোন ফসলের উচ্চতা পরিমাপ এবং রেকর্ড করে। এ ক্ষেত্রে লিডার রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা লেজার দিয়ে ফসলকে আলোকিত করে এবং প্রতিফলিত পদার্থ পরিমাপ করে দূরত্ব গণনা করে। এটি কৃষকদের কৃষি উৎপাদন সর্বোত্তম করতে এবং টেকসই কৃষিকাজ অনুশীলন প্রচারে সহায়তা করে। জৈবিক পর্যবেক্ষণ- জৈবিক সেন্সরযুক্ত ড্রোনগুলো বায়ু বা পানির গুণমান রিডিং নেওয়ার জন্য অনিরাপদ অঞ্চলে উড়ে যায়। সেখানে ড্রোনগুলো নির্দিষ্ট অণুজীব এবং বায়ুমণ্ডলীয় উপাদানের উপস্থিতিও পরীক্ষা করে। দাবানল পর্যবেক্ষণ- ক্ষতির পরিমাণ এবং আগুন কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তা নির্ধারণের জন্য দমকলকর্মীরা ড্রোন ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা জরিপ করছেন। তোলা ছবিতে ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। খেলাধুলার কাভারেজ- টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো খেলাধুলার ইভেন্টের ফুটেজ ধারণ করার জন্য ড্রোন ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।
উল্লেখ্য ড্রোন শব্দটির প্রচলন শুরু হয় রানি মৌমাছির নামকরণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি নাটক থেকে। তবে ড্রোনের প্রচলন শুরু হয় ১৮৪৯ সালে ইতালিতে, যখন ভেনিস অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল। অস্ট্রিয়ান সৈন্যরা তখন গরম বাতাস, হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম ভর্তি বেলুন দিয়ে বোমা ছেড়েছিল ভেনিসে। ১৯১৭ সালে, মার্কিন সেনাবাহিনী পরীক্ষামূলকভাবে ক্যাটারিং বাগ তৈরি করে, যা ছিল একটি মনুষ্যবিহীন উড়ন্ত বোমাবিমান বা ড্রোন, ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৩৫ সালে। অতিসম্প্রতি (২০২২-২৪) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষই ড্রোন ব্যবহার করছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এগুলো তথ্য সংগ্রহ এবং লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যাম করে ড্রোনের সংকেত ব্লক করার জন্য ইলেকট্রনিক যুদ্ধ পদ্ধতিও ব্যবহৃত হচ্ছে এগুলোতে। ইসরায়েলি ড্রোনগুলো আরও আধুনিক। এগুলো ছদ্মবেশী হিসেবে কাজ করে, যোগাযোগ ব্যাহত করে এবং রিয়েল-টাইম ভিডিও পুনরুদ্ধারের সুযোগ প্রদান করে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়