বসন্ত শুরু হয়ে গেছে। প্রকৃতি থেকে শীতের হালকা শীতলতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, মৃদু বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। বাতাসের সঙ্গে দূরের কোনো হাসনাহেনা গাছের ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রাতে আকাশের গায়ে যেন এক রুপালি টিপ, নিঃস্বার্থভাবে কোমল আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। সত্যিই কি কেউ এভাবে নিঃস্বার্থভাবে কিছু দিতে পারে?
সকালে সুপারি গাছতলায় লিমা আর কলির মধ্যে দুটো সুপারি নিয়ে ঝগড়া বাধল। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছিল না। কলি বলল, ‘আমি আগে দেখেছি, এটা আমার।’ লিমা বলল, ‘তুই দেখেছিস আর আমি আগে ধরেছি, যে আগে ধরবে সেই পাবে।’ একসময় চুলোচুলি শুরু হয়ে গেল। অথচ লিমা চাইলে একটা সুপারি কলিকে দিয়ে আরেকটা নিজে রাখতে পারত। এসব ভেবে চাঁদ দেখতে দেখতে সুমনের মনে প্রশ্ন জাগল।
ছেলেটা এখনো কত ছোট, তবু নিয়ম করে চাঁদ দেখে। মা যখন চুলায় রান্না করে, তখন উঠানে পিঁড়ি পেতে একগালে হাত চেপে মুখ আধা হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এখন বসন্ত, তাই একটা মেহগনি গাছের ডালেও কোনো পাতা নেই-কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। একটা পাখি অদ্ভুত কণ্ঠে কোথাও বসে ডাকে; কোন জায়গা থেকে ডাকছে সেটা জানার খুব ইচ্ছে সুমনের। মায়ের সঙ্গে প্রায়ই পাখি নিয়ে তার লম্বা আলোচনা হয়। শেষবার মাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘আচ্ছা মা, এই পাখিটা রাতেই ডাকে কেন? পাখির কি কান্না পায়? তুমি যে রাত হলেই কাঁদো, পাখিটাও কি তেমনই কাঁদে? তোমরা দুজনেই কেন কাঁদো?’
ছেলের মুখে এই কথা শুনে সুমনের মা বঁটিতে বেগুন কাটতে কাটতে হঠাৎ নিজের আঙুল কেটে ফেললেন। প্রতি রাতে যে তিনি কাঁদেন, সেটা সুমন কীভাবে জানল-এই ভাবনাতেই স্তব্ধ হয়ে রইলেন তিনি।
মা যখন ‘ইস’ করে নিজের আঙুল খামচে ধরলেন, সুমন দেখল আঙুলের ফাঁক গলে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে রইল সেই দিকে।
এরপর কোনোদিন আর সুমন কান্নার কথা তোলেনি। সেদিন সে বুঝেছিল, এই প্রশ্নটা করা যেন ভারি অন্যায় হয়ে গেছে।
আজ আকাশ একদম পরিষ্কার। তারাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঝিকমিক করছে। সুমন ভাবছে, বাবা যদি আমাদের একা করে না যেতেন! মা যে একটা ছোট স্কুলে চাকরি করে সংসার চালাচ্ছেন, তাকে পড়ালেখা করাচ্ছেন, বাবা থাকলে মায়ের এত কষ্ট করতে হতো না।
সুমন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজে নিজেই বই নিয়ে বসে। আগে মায়ের চোখ রাঙানোর ভয়ে বসত, এখন আর তা প্রয়োজন নেই। ততক্ষণে মা সকালের রান্না সেরে স্কুলের জন্য রেডি হয়ে যায়। ছেলেকে নিয়ে নাশতা করে দুজনেই বের হয়। তারপর ঘরে সুমন একা থাকে। তার স্কুল শুরু হয় ১০টায়, এখনো অনেক দেরি। এই সময়টা তার কাটে না। পড়ায় মন বসে না। এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
বাবা কেন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে জিততে পারলেন না? বাবা তো বলতেন, মন থেকে কিছু চাইলে আর চেষ্টা করলে সবকিছু জয় করা যায়। তাহলে কি বাবা ইচ্ছে করেই হেরে গেলেন? মন থেকে সুস্থ হতে চাননি?
বিকালে সুমন ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। এই ছাগলটা বাবার রেখে যাওয়া শেষ সঞ্চয়। বাবা বলেছিলেন, ‘আর দুই বছর পরেই তুই হাই স্কুলে উঠবি। তখন তোকে এখানে পড়াবো না, শহরের বড় স্কুলে ভর্তি করাবো। ক্যাডেট স্কুলে পড়লে তুই সহজেই আর্মি অফিসার হতে পারবি। ভর্তি সময় টাকা লাগবে, তখন এই ছাগলটা বিক্রি করে তোকে ভর্তি করাবো।’
এক বছর কেটে গেছে। ছাগলটাও বেশ বড় হয়ে গেছে। এক দিন সুমন মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমাকে কি সত্যিই আগামী বছর ক্যাডেটে ভর্তি করাবে?’
মা উজ্জ্বল হাসিতে বলেছিলেন, ‘তোর বাবার স্বপ্ন আমি নষ্ট করব কেন? তোর কি ইচ্ছে নেই?’
সুমন বলেছিল, ‘তা আছে। তবে আমি হোস্টেলে চলে গেলে তুমি কীভাবে একা থাকবে?’
মা হেসে বললেন, ‘আমার কিছুই হবে না। কয়েক বছরের ব্যাপার। তারপর তুই যখন অফিসার হয়ে যাবি, তখন আমাকে নিয়ে যাস তোর সঙ্গে।’
ওই কথা শুনে সুমনও হেসেছিল। কিন্তু তার মনে ভয়-এই গ্রামীণ স্কুলের পড়া নিয়ে সে কি শহরের ছেলেদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে? যদি না পারে? যদি পড়া থেকে ছিটকে যায়? তবে মায়ের কী হবে, আর বাবার স্বপ্নটা? ভাবতে ভাবতে তার মাথা ঘুরে আসে।
মা একবার তার মুখ দেখে বললেন, ‘এখনো এক বছর সময় আছে। ভালো করে প্রস্তুতি নিলে তুইও পারবি। আর আমি তো আছিই তোকে ঠিক পথে চালিয়ে নিতে।’
সুমন বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে যা ভাবে, মা যেন মুখ দেখে সব বুঝে ফেলেন! সবার মা-ই কি এমন? না, সব মা এমন নয়। রবিন সেদিন বুড়ির গাছ থেকে লাউ চুরি করে এনে মাকে বলেছিল কিনে এনেছে, আর তার মা সেটা বিশ্বাসও করে ফেলেছে। তাহলে রবিনের মা কি তার মনের কথা বোঝেন? না। কিন্তু সুমনের মা বোঝেন। কীভাবে বোঝেন সেটা রহস্য। আর এই কারণেই সে কখনো মায়ের কাছে মিথ্যে বলার সাহস পায় না।
পড়ন্ত বিকালে স্টেশনে যাত্রীদের ভিড়। ট্রেনের অপেক্ষায় সবাই রেললাইনে উঁকি দিচ্ছে। স্টেশনের এক কোণায় সুমন, তার মা আর মামা দাঁড়িয়ে। সুমন ক্যাডেট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েছে। আজ মামা তাকে হোস্টেলে পৌঁছে দেবেন। শুরু হবে নতুন জীবন-মাকে ছাড়া থাকার জীবন।
সুমনের চোখে পানি জমে উঠছে। অথচ মায়ের মুখে আজ এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা। তিনি বারবার সাবধান করে যাচ্ছেন, ‘ট্রেনে বসে যেন জানালার বাইরে হাত না দিস, অপরিচিত কারো দেওয়া কিছু খাবি না।’
সুমন মনে মনে ভাবছে, মা একটুও কাঁদছেন না কেন? তার কি একটুও খারাপ লাগছে না?
ঠিক তখনই ট্রেন এসে দাঁড়াল। একে একে সব যাত্রী উঠে গেল। সুমনরা সিটে বসে জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিল। মা দাঁড়িয়ে আছেন স্টেশনে। হুইসল বাজতেই ট্রেন ধীরে ধীরে গড়াতে শুরু করল। সুমন এবার লক্ষ করল-মায়ের মুখে অমাবস্যা নেমে এসেছে, চোখে জল।
ট্রেন চলতে লাগল। মায়ের মুখ ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। চারপাশের হইচই আর শব্দ কানে ঢুকছে না। শুধু মায়ের শেষ কথাটা বারবার কানে বাজছে-
‘বাবার স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত থামবি না।’