অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কার্যক্রমে জনগণের অংশীদারিত্ব তৈরি করা ছিল কমিউনিটি পুলিশিংয়ের লক্ষ্য। অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থার লক্ষ্যে ‘পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ’-এ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু হয় কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের।
তবে গত পাঁচ বছরে দলীয় পরিচয় বিবেচনায় নিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দিয়ে রাজধানীর ৫০টি থানার কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া খুনের আসামি এবং মাদক মামলার আসামিকে নিয়েও কমিউনিটি পুলিশিং চালুর অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে অনুমোদন হওয়া রাজধানীর ৫০টি থানার কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটিগুলোর তালিকা এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর মিরপুর থানার কমিউনিটি পুলিশিংয়ের উপদেষ্টা মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম হানিফ। আর কার্যনির্বাহী পরিষদের সভাপতি দেওয়ান আবদুল মান্নান। তিনি মিরপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। থানা আওয়ামী লীগের সদস্য আলমগীর হোসেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গত অক্টোবরে মিরপুরে মুত্তাকিন হত্যা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেলহাজতে। মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী শামসুন্নাহার লাভলী মহিলা সম্পাদিকা। মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন টেনু সদস্য। টেনুর বিরুদ্ধে রডভর্তি ট্রাক ছিনতাইয়ের অভিযোগ আছে। তাকে আবার রূপনগর থানা কমিটির সহসভাপতি করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাঈল মোল্লা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মিরপুর থানা কমিটির সদস্য। মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য হায়দার আলী খান বহুলুলও সদস্য। পল্লবী কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মনজুর রহমান মনু মোল্লা, সহসভাপতি ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হালিম মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আফাজ উদ্দিন সরদার এবং সদস্য পল্লবী থানা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পদক মিজানুর রহমান মিন্টু, পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের জিন্নাত আলী মাতুব্বর।
কাফরুল থানার কমিউনিটি পুলিশিং সমন্বয় কমিটির সদস্য ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ইসমাইল হোসেন, মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম ক্রিক এবং ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রোকেয়া জামান। তিনি যুবদল নেতা শামীম হত্যা মামলায় গত বছরের নভেম্বরে গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে। শাহ আলী থানা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের উপদেষ্টা থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি কাজী টিপু সুলতান, ৯৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবদুল মান্নান, একই ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এ আর রাজিব যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ আলী থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মফিজুর রহমান শুভ, মহিলা সম্পাদিকা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিখা রানী চক্রবর্তী।
দারুস সালাম থানার কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্যসচিব আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মুজিব সরোয়ার মাসুম। এ ছাড়া সদস্য ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মী আবু তাহের, থানা আ.লীগের সহসভাপতি মো. গিয়াসউদ্দিন, থানা আ.লীগের সদস্য মাহমুদুল রহমান রাসেল, শ্রমিক লীগ নেতা আমান উল্লাহ এবং আব্বাস উদ্দিন। যাত্রাবাড়ী থানা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সাধারণ সম্পাদক শ্যামপুর থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার কাজী সামিউল রহমান, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড আ.লীগ নেতা জাহিদুল কবির রাজু হলেন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ৬২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক উজ্জল আহমেদ বিপ্লব হলেন সদস্য। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. রেজাউল করিম বলেন, আগে অনেক কিছু হয়েছে। এখন আমরা নতুন ফরম্যাটে কমিউনিটি পুলিশিং চালু করার চিন্তা করছি। যাতে সব শ্রেণির মানুষ সেবা পেতে পারে।
জানা যায়, ২০১৪ সালে পুলিশ সদর দপ্তরের অর্গানোগ্রামে ডিআইজির (অপারেশন্স) অধীনে একজন এআইজির তত্ত্বাবধানে পাবলিক সেইফটি অ্যান্ড ক্রাইম প্রিভেনশন (পিএস অ্যান্ড সিপি) শাখার কার্যক্রম শুরু হয়, যা বর্তমানে কমিউনিটি পুলিশিং নামে পরিচিত। দেশের সব জেলায় কমিউনিটি পুলিশিং সেল রয়েছে এবং প্রতিটি থানায় কমিউনিটি পুলিশিং অফিসার রয়েছে। দেশের প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলায় কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি কার্যকর রয়েছে। যেসব কমিটিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ থাকার কথা।
কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রম : কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির উদ্যোগে সব থানা ও ওয়ার্ডে এবং ইউনিয়ন পরিষদে সামাজিকভাবে জমিজমা, টাকাপয়সা, লেনদেন, স্বামী-স্ত্রী কিংবা পারিবারিক বিরোধ, বাল্যবিয়ে, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, যৌতুক, ইভটিজিং, আত্মহত্যা ও মাদকবিরোধী কার্যক্রম, পরিবহন শ্রমিকদের সচেতন করা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই প্রতিরোধ সংক্রান্তে নিয়মিত মিটিং ও জনসচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও নাশকতা প্রতিরোধে পুলিশকে সার্বিক সহায়তা করা। সারা দেশে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রম তদারকি করা হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।
১৬ মামলার আসামি জুয়েল : গত ১১ জানুয়ারি চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদকসহ ১৬ মামলার আসামি জাহিদ হোসেন ওরফে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে মতিঝিল থানা পুলিশ। তিনি যাত্রাবাড়ী থানা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সিনিয়র সহসভাপতি। জানা যায়, যাত্রাবাড়ী কাঁচা বাজারে দুই শতাধিক স্থায়ী ও শতাধিক অস্থায়ী দোকান রয়েছে। জামাই ফারুকের নেতৃত্বে প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ৪০০ টাকা চাঁদা নিত জাহিদ হোসেন জুয়েলসহ আরও অনেকে।
ধর্ষণ মামলার আসামি কমিউনিটি পুলিশিংয়ে : গত বছর রাজধানীর মিরপুর বাংলা স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল খোশনবীশের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এক নারী সহকর্মী (আয়া) মামলাটি করেন। মোস্তফা কামাল খোশনবীশ কমিউনিটি পুলিশিংয়ের পল্লবী থানা কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
মামলায় ওই নারী অভিযোগ করেন, মোস্তফা কামাল তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন। আবার ধর্ষণের দৃশ্য গোপনে ধারণ করে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
কমিউনিটি পুলিশিং সম্মাননা পান মাদক মামলার আসামি : ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে বিশেষ অবদান রাখায় উজ্জ্বল কুমার ভৌমিক নামে মাদক মামলার এক আসামিকে উপজেলার শ্রেষ্ঠ কমিউনিটি পুলিশিং সম্মাননা দেওয়ার অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। জানা যায়, ২০১৫ সালে ইয়াবাসহ এপিবিএনের হাতে আটক হন উজ্জ্বল কুমার ভৌমিক।