চট্টগ্রাম! ৩০ মে ১৯৮১! রাতের চতুর্থ প্রহর! ঘড়ির কাটায়- ২.৩০ মিনিট! রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক কর্মব্যস্ত শুক্রবার সবে শনিবারে গড়িয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা, একটু আগের হঠাৎই মুষল ধারার বৃষ্টি আর বজ্রপাত সামান্য কমলেও মে মাসের তীব্র গরমকে সেটা আরো ভ্যাপসা করে তুলেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝেই কালুরঘাট ব্রিজের কাছে লে: কর্নেল দেলোয়ারের বাসায় বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিধারা বদলে দেয়ার ষড়যন্ত্রের সভায় যোগ দিয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আসা কয়েকজন মাঝারি সেনা কর্মকর্তা, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের কৌশল বর্ণনা করছে সকালেই রাঙ্গামাটি থেকে আসা লে. কর্নেল মতিউর রহমান। তিনটি পৃথক দলে সার্কিট হাউজ আক্রমনের দায়িত্ব বন্টনের নির্দেশনা তার।
সারাদেশের মতো চট্টগ্রাম শহরও সেদিন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। প্রেসিডেন্ট জিয়া সে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের ভিআইপি কক্ষে তাহাজ্জুদ শেষ করে ফজরের প্রতীক্ষায়, পরিধানে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। হঠাৎই চারদিক কাঁপিয়ে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ প্রেসিডেন্টের কক্ষ লক্ষ্য করে। লে: কর্নেল ফজলে হাসানের নিক্ষিপ্ত দুটো রকেট শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সার্কিট হাউজের দোতালায় তাঁর শয়নকক্ষের নীচের কার্নিশের একটা অংশ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনা কি দেখতে দরজা খুলে সিঁড়ির দিকে এগোতেই সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত গতিতে উঠে আসা একদল সেনার সামনাসামনি প্রেসিডেন্ট।
প্রায় অরক্ষিত সার্কিট হাউজের দোতলায় বিনা বাধায় উঠে আসা প্রথম দলে ক্যাপ্টেন মোসলেহউদ্দীনের বলা- “আমাদের সাথে যেতে হবে স্যার” কথাগুলো পুরোপুরি শেষ হবার আগেই দ্বিতীয় দলের সামনে থাকা আকণ্ঠ মদের নেশায় টলায়মান অপ্রকৃতিস্থ লে: কর্নেল মতিউর প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে সাব মেশিনগানের ম্যাগাজিনের সবকটা গুলিতে প্রেসিডিন্টের মাথা আর বুকে ২৭টা বুলেটের নির্মম প্রাণঘাতী আঘাত। এমন আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব লে: কর্নেল মতির সাথে আসা অন্য সেনারা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় সেনাদল একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে অধিক দ্রুততায় নেমে গেল নিচে, ষড়যন্ত্র পরিকল্পনায় প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার কথা তো ছিলো না! সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে রইলো রাষ্ট্রপতির নিথর দেহ। ২০০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িতে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন দুই কিশোর তারেক আর আরাফাতের ললাট লিখনে পিতৃহারার চিরস্থায়ী চিহ্ন রচিত হলো সবার অগোচরে। ‘‘কাল সকালেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ” বেগম জিয়াকে কয়েক ঘণ্টা আগে দেয়া শেষ প্রতিশ্রুতি অপূর্ণই রয়েগেল। এক মাতাল ঘাতকের বুলেটে তার জন্য নির্ধারিত হলো এক দীর্ঘ বৈধব্য যাত্রার- তিনি জানতেও পারলেন না। মাত্র বিশ মিনিটের এক হঠকারী অভিযানে নিশ্চিহ্ন হলো বাংলাদেশের সম্ভাবনার অগ্রযাত্রা, নিদ্রাচ্ছন্ন দেশবাসীর অগোচরে।
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর শহীদ জিয়া, এক সাথে জড়িয়ে থাকা তিনটি অবিচ্ছেদ্য নাম। এক তরুণ মেজর জিয়া জীবনের মায়া তুচ্ছ করে, তরুণী স্ত্রী আর শিশু পুত্রদের চরম বিপদগ্রস্ত করে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা, দায়িত্ব পালন করেছিলেন জেড ফোর্স আর এক নম্বর সেক্টর কমান্ডারের। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন চট্টগ্রাম তার দ্বিতীয় বাসস্থান। বগুড়ার বাগবাড়িতে জন্ম নেয়া সেই ক্ষণজন্মা মানুষটি আজ নিথর পড়ে আছেন তার প্রিয় দ্বিতীয় বাসভূমিতে। সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে, সবুজ পাহাড়ের গা-বেয়ে ভেসে আসা ভোরের স্নিগ্ধ হওয়া পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে তার প্রাণহীন দেহে। তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে সকল ভয়কে জয় করে দৃঢ়চিত্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশপ্রেমের সাথে সাহসিকতার যে প্রমাণ সেদিন বিশ্ববাসীকে তিনি দিয়েছিলেন, দেশের শতকোটি মানুষের ভালোবাসায় ধন্য হয়ে দেশমাতৃকার মাটির সাথে নিজের উষ্ণ রক্ত স্রোত একাকার করে আজ আবারও প্রমাণ করলেন দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণের নাম জিয়াউর রহমান।
অথচ ২৯ মে’র সকালটা ছিল অন্যরকম, চট্টগ্রাম বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটাতে হঠাৎ চট্টগ্রামে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন দলের চেয়ারম্যান হিসেবে। এলেন ইরান-ইরাক যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আল-কুদস কমিটির সভা বিলম্বিত করে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পরিস্থিতি একটু ঘোলাটে এই সতর্কতায় সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল মোহাব্বত জান চৌধুরী তাকে চট্টগ্রাম যেতে নিষেধ করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া অবজ্ঞা করলেন সতর্কবাণী। গোয়েন্দা প্রধান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রপতিকে বিনয়ের সাথে অন্তত রাত্রি যাপন না করতে অনুরোধ করলেন, সতর্কতার একটিও কাজে এলো না। একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে তিনি সবসময়ই বিশ্বাস করতেন জন্ম মৃত্যু সম্পূর্ণ পূর্ব নির্ধারিত, এর অন্যথায় ক্ষমতা মানুষের নেই, আর বার বার মৃত্যুকে কাছে থেকে দেখা বীর সৈনিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা করতেন জিয়া সেদিন সেটাই করেছিলেন। প্রায় অরক্ষিত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গার্ড রেজিমেন্টের গুটিকয়েক সৈন্য আর দোতলায় দুজন দেহরক্ষী রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিল না। প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ বিমানের নিয়মিত ফ্লাইটে চট্টগ্রামে পৌঁছালেন ২৯ মে সকালে, সাথে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমেনা রহমান। বিমানবন্দরের অভ্যর্থনা লাইনে অনুপস্থিত দেখলেন চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে। সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদের পরামর্শে জেনারেল মঞ্জুর তখন স্টাফ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বদলির আদেশপ্রাপ্ত। প্রেসিডেন্ট জিয়া আর জেনারেল মঞ্জুরের ঘনিষ্ঠতার কথা সেনাবাহিনীতে সবারই জানা। প্রখর বুদ্ধিমত্তার জন্য সবাই তাকে মঞ্জুরকে জানে ‘পন্ডিত’ হিসেবে। সার্কিট হাউসে পৌঁছেই চেয়ারম্যান জিয়া শুরু করলো চট্টগ্রাম বিএনপি’র সাংগঠনিক সভা। মাঝে জুমার নামাজের বিরতিতে প্রেসিডেন্ট কাছেই চকবাজারের চন্দনপুরা মসজিদে জুমার নামায আদায় করলেন, নামাজ শেষে কুশল বিনিময় করলেন মুসল্লিদের সাথে, দুপুরে মধ্যহ্নভোজে বরাবরের মতো সাদামাটা ডাল ভাত। তারপর আবারো ম্যারাথন মিটিং রাত এগারোটা অব্দি। চট্টগ্রামের বেসামরিক প্রশাসনের সাথে নির্ধারিত সভা বাতিল হলো সন্ধ্যার পর। ওদিকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে প্রনীত হচ্ছে এক হঠকারী পরিকল্পনার নকশা।
সেনাপ্রধান এরশাদের কুটচালে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন, হচ্ছেন হয়রানির শিকার। এ কারনে রাষ্ট্রপতি জিয়াকে সেনানিবাসে এনে সেনাপ্রধান এরশাদের অপসারণ, সেটাই ছিল প্রাথমিক পরিকল্পনা। এই আপাত রক্তপাতহীন পরিকল্পনার সাথে সবার অজান্তে যুক্ত হলো লে: কর্নেল মতি’র ভুল ধারণাপ্রসূত ব্যক্তি প্রতিশোধের হঠকারী সিদ্ধান্ত, সেটা ষড়যন্ত্রে অন্য অংশগ্রহনকারীরা জানতেও পারলো না। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য তাকে বাদ দিয়ে কর্নেল সাখাওয়াত কে নির্বাচিত করার দায় রাষ্ট্রপতির উপরে চাপিয়ে সেনাপ্রধান এরশাদ কৌশলে লে: কর্নেল মতিকে উত্তেজিত করেছে আগে থেকেই। আকণ্ঠ মদ্যপানে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মতিকে তৈরি করা হলো এক ঘাতক সেনা কর্মকর্তা হিসেবে। অন্যদের কাছে যা রইলো সম্পূর্ণ অজানা, রক্তপাতহীন পরিকল্পনা পর্যবসিত হলো এক নিষ্ঠুর অমানবিক হত্যাকাণ্ডে।
ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় জেনারেল মঞ্জুর হলেন খলনায়ক, পরিষ্কার দেখতে পেলেন নিয়তি আর কলঙ্কময় পরাজয়। বিচারপতি সাত্তার দায়িত্ব নিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির। সকলের সমর্থন হারানো জেনারেল মঞ্জুর বান্দরবানের দিকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন সপরিবারে, সাথে লে: কর্নেল মাহবুব আর মোজাফফরের পরিবার। রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হলে আশ্রয় নিলেন ফটিকছড়িতে এক পাহাড়ী পরিবারে, কিন্তু তাদের অবস্থান টের পেয়ে সেনাবাহিনীর অনুগত দলের বেষ্টনীতে পড়ে গেলেন, গোলাগুলিতে নিহত হলো লে: কর্নেল মতি আর লে: কর্নেল মাহবুব। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মূল হত্যাকারীর শোচনীয় মৃত্যু হলো ৪৮ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই। পালিয়ে গেলো মেজর মোজাফফর। জেনারেল মঞ্জুর ধরা পড়লেন, তাকে আনা হলো হাট হাজারী থানায় পুলিশ হেফাজতে। নিজের পরিণতি আর সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে বারবার অনুরোধ করছেন তাকে যেন সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর না করা হয়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস থেকে শুরু করে ডিআইজি শাহজাহান সাহেব কেউই তার অনুরোধ রাখেননি। ওসি কুদ্দুস ক্যাপ্টেন এমদাদ-এর কাছে হস্তান্তর করলো জেনারেল মঞ্জুরকে, হাত-পা বাঁধা জেনারেল মঞ্জুরকে গাড়িতে তোলা হলো চরম অপমানজনকভাবে, তারপর নেয়া হলো চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। সেখানে সেনাপ্রধান এরশাদ প্রেরিত দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার একজনের গুলিতে সেই রাতেই নিহত হলেন জেনারেল মঞ্জুর। পরদিন সামরিক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হলো বিক্ষুব্ধ সেনা সদস্যের হাতে নিহত হয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ডা: লে: কর্নেল তোফায়েলের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পাওয়া গেল ভিন্ন তথ্য- ‘মঞ্জুরের মাথায় একটি মাত্র গুলি’। তড়িঘড়ি দাফন করা হলো তাকে, জীবিত বা মৃত কোনভাবেই তাকে ঢাকায় পাঠানো হলো না। রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার রহস্য উদঘাটনের অন্যতম সূত্র জেনারেল মঞ্জুরকে সরিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবী থেকে। রাজধানীর বাইরে বিচ্ছিন্ন এক সেনানীবাসে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা পরিবর্তন যে প্রায় অসম্ভব মঞ্জুরের মত একজন সেনা নায়কের সেটা না জানার কথা নয়। রহস্য আর জিজ্ঞাসার এ অংশটুকু আজও অনুদঘাটিতই রয়ে গেলো।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা যে আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর গাত্রদাহের কারণ তারাই জিয়াউর রহমানের অস্তিত্ব বিলীন করতে চাইবে এই সরল সত্য বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত করার প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য জেনারেল মঞ্জুরের বিচার বা বেঁচে থাকার সুযোগ ছিল না।
এদিকে ৩০ তারিখ সকালে মেজর শওকত আলী ও মোজাফ্ফরের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্ট জিয়া’র কার্পেট মোড়ানো মৃতদেহ সার্কিট হাউজ থেকে সকাল সাড়ে নয়টায় সেনাবাহিনীর গাড়িতে নেয়া হলো অজ্ঞাতস্থানে, লোকচক্ষুর অন্তরালে দাফনের উদ্দেশ্যে।
অসম্ভব জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সম্ভাব্য জনরোষ এড়াতে সার্কিট হাউজ থেকে ২২ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ের ঢালে তড়িঘড়ি করে যেনতেন ভাবে জানাজা করে তার মৃতদেহ অসম্মানজনক দাফনের নামে একরকম মাটি চাপা দেয়া হলো। বিদ্রোহের নামে সংঘটিত হঠকারী সেনা তৎপরতা থেমে গেল স্বাভাবিকভাবেই, ঘাতকের দল হয় ধরা পড়লো অনুগত সেনাবাহিনীর হাতে, নয়তো পালিয়ে গেল। পরিস্থিতি শান্ত হতেই ১লা জুন সকালে প্রথমেই শুরু হলো শহীদ প্রেসিডেন্টের মৃতদেহের খোঁজ। কর্নেল হান্নান শাহের নেতৃত্বে সেনা দল কিছুক্ষণের মধ্যেই রাঙ্গুনিয়ায় বাংলাদেশ টোবাকো কোম্পানির পিছনের পাহাড়ের ঢালের অগভীর গর্ত থেকে উদ্ধার করলো রাষ্ট্রপতির মৃতদেহ। সেটি নেয়া হলো চট্টগ্রাম সেনানিবাসে, মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করলেন সেনাবাহিনীর প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ লে: কর্নেল ডা: তোফায়েল আহমেদ ময়নাতদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ড্রেসিং করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন, বিগ্রেডিয়ার হান্নান শাহ এদের তত্ত্বাবধানে বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে পাঠানো হলো ঢাকায়। পুরাতন বিমানবন্দরে সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সেই হৃদয়বিদারক মুহূর্তের মুখোমুখি হলেন বেগম খালেদা জিয়া আর তার দুই কিশোর পুত্র। সামরিক অভিবাদনে শেষ বিদায় সম্পন্ন হল বিউগলের লাস্ট পোস্টে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে তখন লক্ষ লক্ষ শোকার্ত মানুষের প্রতীক্ষা, তাদের প্রিয় মানুষের জন্য ইতিহাসের বৃহত্তম জানাযায় অংশগ্রহণের আকাঙ্খায়। সে এক অবিস্মরণীয় শোকাবহ দৃশ্য। ঢাকা আর আশেপাশের শহরের কোনো স্বক্ষম ব্যক্তি সেদিন ঘরে বসে ছিল না। ‘এদিকে ১লা জুন বিকেলে একইসাথে বিশাল জনসমূদ্রে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত হলো গায়েবানা জানাজা। চট্টগ্রামের ইতিহাসে কোনো জানাজা দূরে থাক কোন জনসভাতেও লালদীঘির ময়দান এত জনসমাগম হয়নি।’ এর আগে ঢাকা স্টেডিয়ামেও এক অবিস্মরণীয় গায়েবানা জানাযা অনিুষ্ঠিত হয়েছে ৩১ মে। বিশ্ববাসী সেদিন সেই জনসমুদ্র দেখে উপলব্ধি করলেন শহীদ জিয়া কতটা জনপ্রিয় দেশবাসীর কাছে। আর গৃহকোনে স্বজন হারানোর শোকে অশ্রুসজল সারাদেশের অগনিত মা বোনেরা, স্তব্ধ সমগ্র বাংলাদেশ। সারাদেশে ৪০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষিত হলো।
জিয়া হত্যাকাণ্ডে কিছু সামরিক কর্মকর্তা অংশ নিলেও একজন সাধারণ সৈনিকও এই অপকর্মে অংশ নিতে রাজি হয়নি।
দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে স্বজন হারানোর ব্যথা এক একটি অধ্যায়ের মতো সেদিন প্রতিফলিত হচ্ছিলো স্মৃতির পাতায়।
রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতায় এক তরুণ মেজরের স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ এর ২৬ মার্চে জেড ফোর্সের অধিনায়কত্ব, ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরে দিশাহীন জাতির সামনে আশার আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভাব, তলাবিহীন দুর্ভিক্ষ কবলিত বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দেয়া, এক দলীয় বাকশালের শৃঙ্খল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ, শৃঙ্খলিত গণমাধ্যমকে অবারিত মুক্তির আস্বাদ দেয়া, মুসলিম বিশ্বে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, পূর্ব আর পশ্চিমের বিশ্বকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করা, খাল খননে সারা বছরের ফসলের সম্ভাবনা সৃষ্টি, আঞ্চলিক সহযোগিতায় সার্কের ধারণার জন্ম দেয়া, তৈরি পোশাক আর মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের সম্ভাবনায় অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন, সততা দেশপ্রেম আর স্বজন প্রীতির ঊর্ধ্বে এক প্রকৃত জনবান্ধব রাষ্ট্রপতির দেখা পাওয়া। উষর আরাফাতের মরুভূমিতে জিয়া-ট্রি’র সুশীতল ছায়ায় চিরস্থায়ী সম্মানের আসনে বাংলাদেশকে পৌঁছে দেয়া, আত্মার আত্মীয় এই মানুষটি আর নেই। এই শোকাবহ সত্যের মুখোমুখি হবার বেদনা সেদিন দেশের সকল মানুষের হৃদয়ে ।
সবাইকে কাঁদিয়ে এই প্রিয় মানুষটির শেষ ঠিকানা আজ সংসদ ভবনের উত্তরে জিয়া উদ্যানের সবুজ শয্যায়, মানুষের ভালোবাসায় যা আজও ভাস্বর আর শুভকামনায় সিক্ত।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৪৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের প্রতিটি ছত্র পরিপূর্ণ সফলতার সোনালি গাঁথায়। তবে তার শাহাদাৎ প্রশ্ন রেখে গেছেন অজস্র, যার উত্তর আজও অজানা আমাদের!
- অসম্ভব জনপ্রিয় এই রাষ্ট্রনায়ককে কেনো ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হলো ?
- তার হত্যার সাথে ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের সংশ্লিষ্টতা কতটা?’ সেই সত্য কেনো উদঘাটিত হলো না?
- কেন ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনের গভীরে যাওয়ার যোগসূত্র ‘জেনারেল মঞ্জুরকে’ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হলো?
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক রাষ্ট্রপতি জিয়াকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদের সংশ্লিষ্টতা কেন সামনে এলো না?
- আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১৩ দিনের মাথায় জিয়ার হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হলো, বিষয়টি কি নিছকই কাকতালীয়?
- মুসলিম বিশ্বে ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় আর বাংলাদেশকে স্থিতিশীল সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ায় যাদের গাত্রদাহ, সেইসব বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার সত্য কেনো আজও উদঘাটিত হলো না?
- ৩০ মে সংঘটিত ঘটনায় শুধুমাত্র সেনা বিদ্রোহের বিচার, শহীদ জিয়া হত্যার বিচার হয়েছে কি?
ইতিহাসের কাছে এইসব প্রশ্নের জবাবের প্রতীক্ষায় রইলো বাংলাদেশ!
বাংলাদেশের আকাশে যতদিন লাল সবুজের পতাকা উড্ডীন থাকবে ততদিনই প্রশ্নহীনভাবে একজনের নাম গর্বের সাথে উচ্চারিত হবে জিয়াউর রহমান।
লেখক : আহবায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল।