২৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ঢাকা শহরে সাংস্কৃতিক চর্চা এখন প্রায় থমকে আছে। দীর্ঘদিনেও এখানে গড়ে ওঠেনি পর্যাপ্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ফলে বিনোদন পিয়াসী মানুষ ভুগছে বিনোদনের খরায়। নাটকপাড়া-খ্যাত সেই বেইলি রোডে এখন আর মঞ্চনাটকের রমরমা আয়োজন নেই। এ নাটকপাড়া এখন ভরে গেছে ফুডকোর্ট আর শাড়ির বাহারি দোকানে। টিএসসিতেও সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাবেশ আর মব কালচারে সয়লাব। সেগুনবাগিচার শিল্পকলা মিলনায়তনও এখন আর আগের মতো সংস্কৃতি নিয়ে মুখর থাকে না। তারপরও শুধু সেগুনবাগিচা ও শাহবাগকেন্দ্রিক হয়ে গেছে ঢাকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এমনটাই মত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। নন্দিত নাট্যকার আবুল হায়াতের কথায়, সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি এবং শাহবাগের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার ও জাতীয় জাদুঘর, উৎসব পার্বণে সারা শহরের চারপাশের সংগীতানুরাগীরা ভিড় করেন এখানে। এর বাইরে সংস্কৃতি বিনিময়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। যে দু-একটি তৈরি হয়েছিল, সেগুলোও প্রায় পরিত্যক্ত।
যানজট আর ঘনবসতির এই নগরে উত্তরা, মিরপুর ও গুলশান এলাকায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। মিরপুরে টাউন হলে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার পরিকল্পনা ছিল। তবে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও এটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
নাটকের মঞ্চগুলো মূলত সেগুনবাগিচাকেন্দ্রিক। বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে নিয়মিত নাটক হয় না। মিলনায়তনটি তুলনামূলক ছোট এবং বেশি ভাড়া হওয়ার কারণে নাটকের দলগুলো এখানে কম আসে। নাটকের উৎসবগুলো মূলত জাতীয় নাট্যশালা এবং পরীক্ষণ থিয়েটারে হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে এখানে উত্তরা, গুলশান, বারিধারা, বনানী, মিরপুর, বাসাবো, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়াসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শক তুলনামূলক কম আসেন নাটক দেখতে।
মিরপুর এলাকার বাসিন্দা আবদুল জব্বার বলেন, ‘নাটক দেখতে ইচ্ছা করে ঠিকই কিন্তু সন্ধ্যার দিকে যানজট বেশি থাকে বলে এতদূর যাওয়ার কথা মনে হলেই সাহসে কুলায় না। যেতে-আসতে চার ঘণ্টা লেগে যায়।’
পুরান ঢাকার মানুষের বিনোদনের চিন্তা করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠা করা হয় মহানগর নাট্যমঞ্চ। কিন্তু অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায় মঞ্চটি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। চালুর পর শুরুতে দু-একটি নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয়েছিল। কিন্তু তারপর নানা কারণে উৎসাহে ভাটা পড়ে। এখন আর সেখানে নাটক হয় না।
মহানগর নাট্যমঞ্চটির অবস্থা মোটেও সংস্কৃতিবান্ধব নয়। মিলনায়তনের ফটক, করিডর ভাসমান লোকজনের দখলে। কৃত্রিম জলাধারে নোংরা পানি, ভাসছে ময়লা। আশপাশে মাদকাসক্ত ও ভাসমান লোকজনের আনাগোনা। অযত্ন-অবহেলায় বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক নাট্যমঞ্চটি প্রায় পুরোপুরি অচল। মিলনায়তনটি রাজনৈতিক সমাবেশ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সভাসহ নানা আয়োজনে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভাড়া নেয় মিলনায়তনটি।
ঢাকা দক্ষিণের বাসিন্দাদের হতাশ করেছে জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ২০০৮ সালে চালু করা হয়েছিল জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখন এ মঞ্চে আলো জ্বলে না বললেই চলে। এখানে শেষ কবে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, এ খবর দিতে পারলেন না গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কেউই। গুলিস্তান ও সূত্রাপুরের মিলনায়তন দুটিতে নাটক মঞ্চায়ন সম্ভব নয় বলে মত দিয়েছেন বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নাট্যকর্মী। দুটি মিলনায়তনের ভাড়া অনেক বেশি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মকর্তাদের কথায়, মিরপুরের মতো এত বড় একটি এলাকায় যেখানে কয়েক লাখ লোকের বসবাস, সেখানে একটিও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই, ভাবা যায়। তাদের মতে, শিল্পকলা একাডেমি সব সময়ই শিল্পের সব মাধ্যমের মধ্যমণি হিসেবে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তা শুধু একাডেমিকেন্দ্রিক হলে চলবে না। উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ২০টি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হওয়া উচিত।
মিরপুরে টাউন হল মিলনায়তনটি দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জন্য দাবি করছিলেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নেতারা। সিটি করপোরেশন থেকে আশ্বাসও মিলেছিল। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেনের সাবেক মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর মিরপুর টাউন হলটিও অনিশ্চিত হয়ে গেছে বলে জানালেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন কর্তাব্যক্তিরা।
এদিকে ঘরোয়া বিনোদন ও সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম টিভি নাটকও এখন আর সত্তর কিংবা আশির দশকের মতো দর্শক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। মানহীন গল্প, নির্মাণ, অভিনয়, বিজ্ঞাপন প্রচারের আধিক্য যেন দর্শককে দূরে ঠেলে দিয়েছে টিভি নাটক। সব মিলিয়ে ২ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার এ ঢাকা শহরের মানুষ ভুগছে বিনোদনের প্রধান উপাত্ত সংস্কৃতির বন্ধ্যত্বে।