গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবা দপ্তরে ঘুষের পরিমাণ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। বিশেষ করে ভূমি, বিচারিক সেবা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বন্দর পরিষেবা, সচিবালয়ে ফাইল ছাড়ানো এবং বিআরটিএ অফিসে ঘুষের হার বেড়েছে অন্তত ৫ গুণ। এসব সেবা খাতে এখন গড় ঘুষের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সাধারণ মানুষের আস্থা রাষ্ট্রীয় সেবাব্যবস্থার প্রতি আরও হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে ঘুষের এ সংস্কৃতি দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙে দিতে পারে।
সেবাগ্রহীতারা জানান, আগে যে কাজের জন্য ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হতো, বর্তমানে সে কাজের জন্য দিতে হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাঁরা আরও অভিযোগ করেন, ঘুষ লেনদেনের এ ব্যবস্থায় নতুন নতুন তদবিরবাজের সক্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদ মওকুফ, নতুন ঋণ অনুমোদন ও মামলার জামিনের ক্ষেত্রে ঘুষের হার অনেক বেড়েছে। এসব খাতে আগে পরিচিত কিছু ব্যক্তি তদবির করলেও বর্তমানে নতুন মুখের দাপট বেড়েছে, যারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করছেন।
এক ব্যবসায়ীর বরাত দিয়ে ঘুষের রেট ৫ গুণ বৃদ্ধির তথ্য দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের আগে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো, এখন ৫ লাখ টাকা দিতে হয়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার জমির খতিয়ান সংশোধনের জন্য আগে ১৫ হাজার টাকা দিলেই কাজ হয়ে যেত। এখন বলছে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা লাগবে। নতুন কিছু লোক এসেছে যারা “লোকদেখানো সহযোগিতা”র নামে মোটা অঙ্ক দাবি করছে।’
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বিচারিক সেবা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতি ও ঘুষের উচ্চহার অব্যাহত রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যদিকে ভূমি, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিআরটিএর মতো সেবায়ও উচ্চমাত্রার দুর্নীতি ও ঘুষ রয়েছে, যা জনগণের মৌলিক অধিকার বাধাগ্রস্ত করছে।’
টিআইবি প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা; যা দেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ। ঘুষ লেনদেনের দিক থেকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি খাত হলো ভূমিসেবা-২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা; বিচারিক সেবা-২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা-২ হাজার ৩৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন-১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান-৮৪০ কোটি ৯০ লাখ টাকা; বিদ্যুৎ-৩০৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা; স্বাস্থ্য-২৩৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং শিক্ষা খাতে-২১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মোট ১৪ খাতের ঘুষসংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট দেশের প্রায় সব ধরনের সেবা খাতেই ঘুষ লেনদেন একটি স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁরা এমন অভিযোগ নিয়মিতভাবে পাচ্ছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধব্যবস্থার দুর্বলতা এ দুর্নীতি প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ঘুষ, তদবির বাণিজ্য একটি রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য যেসব অব্যবস্থাপনা আছে সেগুলো উত্তরণের মধ্যে নতুন বাংলাদেশ পাব, জুলাই বিপ্লব আমাদের সেই স্বপ্নে বিভোর করেছিল। সেই জায়গায় আমাদের হোঁচট খেতে হয়েছে। ঘুষ ও তদবিরের ক্ষেত্রগুলোয় ব্যবস্থার পরিবর্তন না হয়ে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। ব্যবস্থার পরিবর্তন না হয়ে শুধু হাতবদল হলে অনিয়ম থেকেই যায়।’