মদিনার খাজরাজ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বনু সালামা শাখার গোত্রপ্রধান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি আমর ইবনুল জামুহ। বেশি বয়সের কারণে শুভ্র চুল। চেহারায় অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত ভাব চিকচিক করছে। গোত্রের যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, নারী—সবার খুব সম্মানের পাত্র তিনি।
কিন্তু ঈমানের নূর থেকে বিচ্যুত অন্তর তখনো শিরকের কালো ছায়ায় আবৃত। তাওহিদের আলোক-মশাল এখনো তাঁর অন্তরের কালো ছায়ায় আঘাত হানতে পারেনি। তাই নিজ গৃহমধ্যে যত্নে রক্ষিত ‘মানাত’ নামের একটি কাঠের মূর্তির পূজা করেন তিনি। মূর্তিটিকে খুব আদর করে গোসল করান; প্রতিদিন আতর মাখান।
কারণ তাঁর আবেদন-নিবেদন আর ভালোবাসা সবই এই কাষ্ঠখণ্ডের প্রতি নিবেদিত। তিনি বিশ্বাস করেন, এই কাষ্ঠখণ্ড তাঁর নিয়তি নির্ধারণের মালিক। তবে সময় থেমে থাকে না। মক্কার বালুকাময় প্রান্তরে তত দিনে আলো ছড়াতে শুরু করেছে হেরার জ্যোতি।
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্রমান্বয়ে বদলে দিচ্ছিলেন আরবের মানচিত্র। ধীরে ধীরে তাওহিদের আহ্বানে জেগে উঠছিল ঘুমন্ত হৃদয়গুলো। ইসলাম তখন ছড়িয়ে পড়ছিল মদিনার অলিগলিতে।
বনু সালামার কিশোর ও যুবকদের অন্তরেও ঢেউ তুলেছে সেই হেরার জ্যোতি। তাঁরা গোত্রপতিকে ভয় করলেও এক অদৃশ্য টানে সব পেছনে ফেলে রাসুল (সা.)-এর ওপর ঈমান এনে ধন্য হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুআজ ইবনে জাবাল (রা.), মুআজ ইবনে আমর (রা.)-এর মতো তরুণরা। তাঁরা আলোর পথ ধরলেও তাঁদের নেতা আমর এখনো আঁধারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত।
এই যুবকরাই শুরু করলেন এক অভিনব দাওয়াতি অভিযান। আলো ছড়াতে চাইলে কখনো কখনো অন্ধকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। তাই তাঁরা রাতের আঁধারে আমরের কাঠের দেবতাকে তুলে এনে ফেলে দিলেন ভাগাড়ে।
সকালে আমর দেখে স্তম্ভিত! কোথায় তাঁর আরাধ্য? খুঁজে খুঁজে পেলেন নর্দমার এক কোনায়। ধুয়েমুছে আতর মেখে আবার রাখলেন যথাস্থানে। অথচ সেই রাতে আবারও ঘটল একই কাণ্ড এবং আবারও পরম যত্নে কুড়িয়ে এনে ধুয়েমুছে আতর মেখে রাখলেন যথাস্থানে। দিনে দিনে আমরের মনে শুধু বিরক্তিই বাড়ছিল না, চেপে বসছিল সন্দেহের ছায়াও।
এক রাতে তিনি কাঠের মূর্তির গলায় ঝুলিয়ে দিলেন একটি তরবারি। আর বললেন, ‘যদি তুমি নিজের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম হও, তাহলে করো!’ অর্থাৎ যদি সত্যিই তোমার কোনো শক্তি থাকে, তাহলে এই তরবারি দিয়ে তোমার অপমানকারীদের শাস্তি দাও।
কিন্তু কাঠের খণ্ড তো কাঠই! সে তো নির্বাক আর নির্জীব। সেই রাতেই যুবকরা এবার আরো একধাপ এগোলেন। মূর্তিটিকে টেনে এনে একটি মৃত কুকুরের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে দিলেন বনু সালামা গোত্রের কূপে।
সকালবেলা আমর ছুটে গিয়ে দেখলেন, তাঁর মূর্তি কূপের তলদেশে উল্টে পড়ে আছে, পাশে জড়ানো এক মৃত পশুর দেহ। হৃদয়ে যেন বজ্রাঘাত হলো।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! যদি তোর মধ্যে কোনো ভালো (ক্ষমতা বা গুণ) থাকত, তাহলে তুই নিজেকে রক্ষা করতে পারতি!’
সেই মুহূর্তেই আমরের শিরকের মোহমুগ্ধতা চূর্ণ হলো। চিরাচরিত বিশ্বাসের মায়াজাল ছিঁড়ে গিয়ে হৃদয়ে উদিত হলো তাওহিদের আলো। আমর ইবনুল জামুহ চললেন রাসুল (সা.)-এর কাছে। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে গ্রহণ করলেন ইসলাম। সেই কাঠের মূর্তির জায়গা নিল আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ঈমান। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৫৮; উসদুল গাবাহ, ইবনে আসির, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩৮২; আসাদুল ঘাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা : ৪/৭৩)
আমর ইবনুল জামুহ (রা.) ইসলামের সোনালি যুগের একজন সম্মানিত সাহাবি। তিনি শুধু একজন প্রবীণ নেতা ছিলেন না, পরবর্তী সময়ে ইসলামের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের কাতারেও নাম লিখিয়েছিলেন। মহান আল্লাহর ওপর ঈমান ও কাঠের মূর্তির মোহভঙ্গ তাঁকে উহুদ যুদ্ধে শাহাদাতবরণের সৌভাগ্য পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।